রাজ্যের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হিন্দুস্তান মেরি জান’ নামে গানের ভিডিয়ো জুড়ে রয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নানা অভিযানের ছবি বা যুদ্ধাভ্যাসের দৃশ্য। গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।
২০২১ সাল যত এগিয়ে আসছে, ততই জল্পনা বাড়ছে রাজনীতির নামী-দামি কেউকেটাদের নিয়ে। কে কখন কোন ডালে বসে রয়েছেন, বোঝা ক্রমশ কঠিন হচ্ছে। আর সে কাঠিন্যের মধ্যেই জল্পনা বাড়িয়ে তুলল একটা গান। রাজ্যের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় গান গাইলেন ভারতীয় সেনার জন্য। বাংলায় নয়, হিন্দিতে গাইলেন তিনি। সে গানের ভিডিয়ো হু হু করে হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ল হোয়াটসঅ্যাপ বেয়ে। এবং রাজীবের এই দেশাত্মবোধের তাৎপর্য খোঁজার চেষ্টাও শুরু হয়ে গেল রাজনৈতিক শিবিরে।
সেনার বীরত্ব, জাতীয়তাবাদ বা দেশাত্মবোধ সংক্রান্ত বিষয়ে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের সুর কিন্তু একটু অন্য রকমই ছিল। পুলওয়ামা কাণ্ড কী ভাবে ঘটল, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের প্রমাণ চাওয়া, বালাকোটে এয়ার স্ট্রাইক নিয়ে নানা সংশয় প্রকাশ করা— তৃণমূলের সব স্তরের নেতা-কর্মীরা এ সবে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে এ বারের চিন-ভারত সঙ্ঘাতে কিন্তু তৃণমূলের সুর বদলে গিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ডাকা সর্বদল বৈঠকে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে এসেছেন যে, এই সঙ্কটের মুহূর্তে তৃণমূল সব রকম ভাবে সরকারের পাশে থাকবে।
রাজ্যের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলেন এ বার। লাদাখে দেশের সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে সম্মান জানাতে হিন্দিতে গান রেকর্ড করলেন তিনি। ‘লাজ বচানে তিরঙ্গাকে দি হ্যায় জিসনে জান / ভারত মাকে বীর শহিদোঁ তুম হো দেশকি শান’— গান শুরু হচ্ছে এই পঙ্ক্তিতে। ‘হিন্দুস্তান মেরি জান’ নামে ৪ মিনিট ৫২ সেকেন্ডের ভিডিয়ো জুড়ে ভারতীয় বাহিনীর নানা অভিযানের ছবি বা যুদ্ধাভ্যাসের দৃশ্য। চূড়ান্ত প্রতিকূলতার মধ্যে বাহিনীর পারদর্শিতা, বায়ুসেনার কেরামতি, ট্যাঙ্ক ব্রিগেডের শৌর্য— টুকরো টুকরো দৃশ্যের কোলাজ। আর সেগুলোকে পটভূমিকায় রেখে মাঝেমাঝে ফুটে উঠছে পশ্চিমবঙ্গের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ, মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর গান গাওয়ার ছবি।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে এ রাজ্যের রাজনীতি কিছুটা নতুন চেহারা নিয়েছে। দলবদলের তালিকা নেহাৎ ছোট নয়। সে তালিকা ক্রমশ আরও লম্বা হবে বলে রাজনৈতিক শিবিরের অনেকেরই দাবি। বেশ কয়েকটা বাঘা বাঘা নাম রয়েছে জল্পনায় ভাসতে থাকা সে তালিকায়। যেমন শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর নামকে ঘিরেই সম্প্রতি কানাঘুষো সবচেয়ে বেশি। সংবাদমাধ্যমে শুভেন্দুর দেওয়া কোনও বিজ্ঞাপন বা রাস্তার ধারে শুভেন্দুর ছবি সম্বলিত কোনও ব্যানারকে ঘিরে সে সব জল্পনা মাঝেমধ্যেই হু হু করে বেড়ে ওঠে। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া গানও কিন্তু ওই সব ব্যানার বা বিজ্ঞাপনের মতো ভূমিকাই নিয়ে নিল। এর আগেও মাঝেমধ্যেই নানা ভাবে প্রচারের আলোয় চলে এসেছেন রাজীব। তাঁর সতীর্থদেরই অনেকে তাঁর ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ নিয়ে বক্রোক্তি করেছেন বিভিন্ন সময়ে। শুভেন্দুর মতো তাঁর গতিবিধি নিয়েও বছরখানেক ধরে নানা গুঞ্জন তৈরি হচ্ছিল। সে সব মাঝে স্তিমিতও হয়ে এসেছিল। কিন্তু নতুন গান সে গুঞ্জনের আগুনে ঘি ঢেলে দিল।
আরও পড়ুন: ত্রাণে বঞ্চনার অভিযোগে সরব বিরোধীরা, মুখ্যমন্ত্রী বললেন দলবাজি চলবে না
রাজীব নিজে কি সে সব গুঞ্জনের আঁচ পেয়েছেন? উত্তর স্পষ্ট ভাবে দিচ্ছেন না মন্ত্রী। তবে জল্পনা নিয়ে তিনি যে ভাবিত নন, তা খুব পরিষ্কার ভাষায় জানাচ্ছেন। বনমন্ত্রীর কথায়, ‘‘আমি একটা দেশাত্মবোধক গান গেয়েছি। সেটাকে কে কী ভাবে নেবেন, জানি না। কিন্তু লাদাখের ওই উঁচু পাহাড়ে, প্রতিকূল পরিবেশে, কখনও কখনও শূন্য ডিগ্রির নীচে নেমে যাওয়া তাপমাত্রায় যাঁরা নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, নিজেদের পরিবার-পরিজনের কথা ভুলে গিয়ে যাঁরা ওখানে দেশের মাটি রক্ষা করছেন, তাঁদের জন্য গাইতে পেরে আমার ভালই লাগছে। আমি মনে করি, ওঁরা ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন বলে, আমরা রাতে ঘরে শান্তিতে ঘুমোতে পারছি।’’ গান গাইলেন ভাল কথা, কিন্তু হিন্দিতে কেন? রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্পষ্ট জবাব, ‘‘প্রথমত, যাঁদের জন্য গেয়েছি, তাঁদের কাছে তো গানটা পৌঁছনো দরকার। তাঁদের অধিকাংশই তো বাংলাটা বুঝবেন না। দ্বিতীয়ত, এই গানটা তো শুধু বাংলার মানুষের জন্য নয়, আমি চাই গোটা দেশই শুনুক।’’
আরও পড়ুন: করোনায় মৃত্যু তমোনাশের, রাজ্যকে খোঁচা দিলীপের
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর এই তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থান সম্পর্কে বিজেপি কী ভাবছে? রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলছেন, ‘‘দেশের সেনার জন্য গান গেয়েছেন, সে তো ভাল কথা। কিন্তু ভুল জায়গায় রয়েছেন তো। যে দলে বা যে সরকারে রয়েছেন, সেখানে থেকে এই গান কি গাওয়া যায়?’’ কেন গাওয়া যায় না? সায়ন্তন মনে করিয়ে দিচ্ছেন সেনা সম্পর্কে তৃণমূলের কিছু মন্তব্যের কথা। বলছেন, ‘‘নবান্ন থেকেই তো বলা হয়েছিল যে, সেনা তোলাবাজি করে। কিন্তু রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় তো এখনও সেই নবান্নের ছায়ায় থেকেই কাজ করছেন। হয় ওই ছায়া ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে ওই কথার প্রতিবাদ করতে হবে। সেনা সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছিল, তা যে তিনি মানেন না, এ কথা রাজীববাবুকে আজ বলতে হবে।’’
বনমন্ত্রী কী বলছেন সে সবের জবাবে? নবান্ন থেকে কী মন্তব্য করা হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে তিনি যাচ্ছেন না। তবে বলছেন, ‘‘আমার মধ্যে বরাবরই দেশাত্মবোধ রয়েছে| আমি দেশাত্মবোধের সঙ্গে কখনই আপস করতে পারব না। যাঁরা সীমান্তে দাঁড়িয়ে রয়েছেন, আমি তাঁদের পাশে গিয়ে হয়তো বন্দুক ধরে দাঁড়াতে পারব না। কিন্তু ওঁদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য যদি আজ লাদাখের সীমান্তে গিয়ে ওঁদের পাশে আমাকে দাঁড়াতে বলা হয়, আমি যাব। যত ঝুঁকিই থাক যাব।’’ মন্তব্য শুনেই বোঝা যায়, এই রাজীব বেশ বেপরোয়া।
সুকুমার সাহিত্যের বেড়াল বলেছিল, গেছোদাদা কখন কোথায় রয়েছেন, বোঝা খুব শক্ত। সেটা কী রকম? বেড়াল বলেছিল, ‘‘সে কি রকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারি। যদি মতিহারি যাও, তাহলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টপুর। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেলেন কাশিমবাজার। কিছুতেই দেখা হবার যো নেই।’’
রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘উলুবেড়ে’র খুব কাছেই পাওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ ডোমজুড়ে, তাঁর নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্রে। কখনও পাওয়া যেতে পারে নবান্নে। কখনও সল্টলেকের অরণ্য ভবনে। কখনও তৃণমূল ভবনে। কিন্তু এ সবের বাইরে আর কোথায় কোথায় তাঁকে পাওয়া যেতে পারে? অদূর ভবিষ্যতে এক গাছ ছেড়ে অন্য গাছের ডালে তাঁকে কি বসতে দেখা যাবে? একটা গানেই জল্পনা জমজমাট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy