রুজিরা নারুলা বন্দ্যোপাধ্যায় ( বাঁ দিকে )। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ( ডান দিকে )। —ফাইল চিত্র।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী রুজিরা নারুলা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বৃহস্পতিবার সিজিও কমপ্লেক্সে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। প্রায় ৪ ঘণ্টা তিনি ইডির দফতরে ছিলেন। মুখোমুখি হয়েছিলেন তদন্তকারীদের। বিকেল ৪টে ২০ নাগাদ সিজিও কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথ ধরেন অভিষেক-পত্নী। ইডি দফতরে প্রবেশ বা সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে রুজিরা কোনও মন্তব্য করেননি। যদিও জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাড়ি যাওয়ার পথে তাঁকে হাসিমুখে সাংবাদিকদের উদ্দেশে হাত জোড় করতে দেখা যায়। ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবারই নিয়োগ মামলায় অভিষেককে তলব করেছে ইডি। কিন্তু তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক জানিয়ে দিয়েছেন, ইডির তলবে সাড়া দিয়ে ওই দিন তিনি সিজিও কমপ্লেক্সে যেতে পারবেন না। তৃণমূলের ‘নবজোয়ার কর্মসূচি’ বন্ধ রেখে তাঁর পক্ষে কলকাতায় গিয়ে ইডির সঙ্গে দেখা করা সম্ভব নয়। অভিষেকের অভিযোগ, তাঁর পাশাপাশি স্ত্রী, পুত্র এবং কন্যাকেও হেনস্থা করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা নাগাদ রুজিরাকে ইডি দফতরে হাজির হতে বলা হয়েছিল। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দিল্লি থেকে ইডি আধিকারিকেরা এসেছিলেন। ইডি আধিকারিক পঙ্কজ কুমার ছাড়াও এসেছিলেন সহকারী অধিকর্তা পদমর্যাদার এক জন। রুজিরা ইডি দফতরে হাজির হতে বেশ কিছুটা দেরি করেন। তিনি সিজিও কমপ্লেক্সে ঢোকেন বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর আইনজীবী। রুজিরার হাজিরাকে কেন্দ্র করে সিজিও কমপ্লেক্সের নিরাপত্তা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে।
ইডি দফতরে রুজিরার হাজিরায় ২টি বিষয় অনেকেরই নজর এড়ায়নি। তা হল, তিনি সিজিও-তে প্রবেশের সময় ছিলেন একেবারে ‘অদৃশ্য’। কালো গাড়ির কালো কাচ তুলে রেখেছিলেন রুজিরা। গাড়ি গিয়ে থামে একেবারে সিজিও-র লিফ্টের সামনে। সকালে সাংবাদিকদের ধারে কাছেই ঘেঁষেননি অভিষেক-পত্নী। কিন্তু ৪ ঘণ্টা পর বিকেল সাড়ে ৪টের কিছু আগে তিনি যখন বেরিয়ে আসেন, তখন আর গাড়ির কাচ তোলা ছিল না। বরং জানলার ধারে বসে হাত জোড় করে নমস্কারের ভঙ্গিতে দেখা গিয়েছে রুজিরাকে। রুজিরার বেরোনোর পর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দিল্লি থেকে আসা ইডি আধিকারিকেরাও সিজিও থেকে বেরিয়ে যান।
এর আগে সোমবার বিমানবন্দরে অভিবাসন দফতর রুজিরাকে আটকায়। তিনি ২ সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে সে দিন দুবাই যাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁকে বাধা দেওয়া হয়। বিমানবন্দর থেকেই রুজিরাকে নোটিস ধরায় ইডি। বৃহস্পতিবার সিজিও কমপ্লেক্সে তাঁকে হাজিরা দিতে বলেন গোয়েন্দারা। রুজিরাকে আটকানোর প্রসঙ্গ টেনে এনে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অমানবিকতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি দাবি করেছিলেন, বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে ইডিকে আগে জানিয়েছিলেন রুজিরা। সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি সত্ত্বেও তাঁকে আটকানো হয়েছে। রুজিরাকে তলব প্রসঙ্গে সরব হয়েছিলেন অভিষেকও। জানিয়েছিলেন, তাঁর জনসংযোগ যাত্রায় বাধা দেওয়ার জন্যই এ সব করা হচ্ছে।
যদিও অভিবাসন দফতর সূত্রে দাবি করা হয়, ইডির একটি মামলায় রুজিরার নামে ‘লুক আউট’ নোটিস জারি হয়েছে। তাই তাঁর বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ রয়েছে। অভিষেকের ঘনিষ্ঠমহল সূত্রে খবর, ইডির ওই মামলায় সুপ্রিম কোর্ট অভিষেক এবং রুজিরাকে রক্ষাকবচ দিয়ে জানিয়েছিল, তাঁদের বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই। তা সত্ত্বেও রুজিরাকে বিমানবন্দরে বাধা দেওয়ার বিরুদ্ধে অভিষেক আইনি পদক্ষেপ করতে পারেন বলেও জানা গিয়েছিল তৃণমূল সূত্রে। কয়লাপাচার মামলায় এর আগে বেশ কয়েক বার অভিষেক এবং রুজিরাকে ইডি জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ২ জনকেই দিল্লিতে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। অভিষেক গেলেও দিল্লি যাননি রুজিরা। গত বছর জুন মাসে শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে তাঁকে কলকাতার ইডি দফতরে ঢুকতে দেখা গিয়েছিল। বৃহস্পতিবার অবশ্য সন্তানদের সঙ্গে আনেননি তিনি। অভিষেক জেলায় নবজোয়ার যাত্রার কর্মসূচিতে ব্যস্ত। আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে রুজিরা একাই ইডির মুখোমুখি হয়েছেন।
কালো কাচে ‘অদৃশ্য’
ইডি দফতরে প্রবেশ করার সময় অভিষেক-পত্নী কার্যত ‘অদৃশ্য’ ছিলেন। সাংবাদিকেরা তাঁকে সে ভাবে দেখতেই পাননি। কালো গাড়িতে কালো কাচ তুলে রেখেছিলেন তিনি। গাড়ি গিয়ে থামে একেবারে সিজিও কমপ্লেক্সের লিফ্টের সামনে। সেখান থেকে ভিতরে ঢুকে যান রুজিরা।
হাসিমুখে হাত জোড়
৪ ঘণ্টার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ইডি দফতর থেকে বেরিয়ে আসেন রুজিরা। তখন কিন্তু তাঁর অন্য ‘রূপ’। এ বার আর গাড়ির কাচ তুলে রাখেননি অভিষেক-পত্নী। বরং গাড়ির জানলায় তাঁকে দেখা গিয়েছে হাসিমুখে। সাংবাদিকদের ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে রুজিরা হাত জোড় করে ছিলেন। সিজিও থেকে বেরোনোর সময় তিনি কিছু বলেননি।
সিজিও-তে চার ঘণ্টা
১১টায় তাঁকে হাজিরা দিতে বলেছিল ইডি। কিন্তু রুজিরা ১২.০৫ নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। সিজিও কমপ্লেক্সে গিয়ে পৌঁছন বেলা সাড়ে ১২টায়। এর পর ইডির গোয়েন্দারা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। বিকেল ৪.২০ নাগাদ রুজিরাকে ইডি দফতর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। অর্থাৎ, তিনি সিজিও-তে ছিলেন ৩ ঘণ্টা ৫০ মিনিট।
জিজ্ঞাসাবাদে দিল্লির কর্তারা
রুজিরাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে দিল্লি থেকে সল্টলেকের ইডি দফতরে এসেছিলেন গোয়েন্দারা। আসেন দিল্লির ইডি আধিকারিক পঙ্কজ কুমার। তাঁর সঙ্গে সহকারী অধিকর্তা পদমর্যাদার এক কর্তাও আসেন। দিল্লিতে গিয়ে রুজিরা হাজিরা দেবেন না বলেই হয়তো দিল্লির কর্তারা কলকাতায় এসে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গেলেন। রুজিরা বেরোনোর পর তাঁরাও সিজিও ছাড়েন।
অভিষেককেও তলব
দলীয় কর্মসূচির সূত্রে অভিষেক এখন নদিয়ায়। বৃহস্পতিবার সেখানেই তাঁর নবজোয়ার যাত্রার সভা ছিল। স্ত্রী রুজিরা ইডি দফতরে হাজিরা দিয়ে সেখান থেকে বেরোনোর কয়েক ঘণ্টা পরেই জানা গেল, প্রাথমিকে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অভিষেককেও তলব করেছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি। তাঁকে ১৩ জুন, মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টায় তাঁকে ইডি দফতরে হাজিরা দিতে বলা হয়েছে। তার প্রেক্ষিতে নবজোয়ার কর্মসূচিতেই অভিষেক বলেন, ‘‘আমার সৌজন্য আমার দুর্বলতা নয়। আপনি যখন ডাকবেন তখনই আমাকে যেতে হবে, তা নয়। পঞ্চায়েত ভোটের আগে ইডির দফতরে গিয়ে ১০-১২ ঘণ্টা অপচয় করার মতো সময় আমার হাতে নেই। ৮ জুলাই পঞ্চায়েত ভোট। তার পর আপনারা যখন ডাকবেন, তখনই যাব।’’
পরিবারকে হেনস্থা: অভিষেক
অভিষেক জানান, রুজিরাকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হওয়ার মিনিট ১৫ পরেই তাঁকে নোটিস পাঠিয়েছে ইডি। অভিষেক বলেছেন, ‘‘সাড়ে ৪টে নাগাদ আমার স্ত্রী ইডির দফতর থেকে বেরিয়েছেন, তার ১৫ মিনিটের মধ্যেই আমাকে আমার বাড়ির ঠিকানায় চিঠি পাঠানো হয়েছে। আমি সেই চিঠি হাতে পাইনি। তবে শুনেছি ১৩ তারিখ ডেকে পাঠানো হয়েছে। যদি ওঁরা কোনও নথি চেয়ে থাকেন তবে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটের আগে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এর আগে যখন ২৪ ঘণ্টারও কম সময় দিয়ে সিবিআই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল, তখনই বলেছিলাম, নবজোয়ার কর্মসূচির পরে ডাকুন আসব। কিন্তু ওঁরা তা করেননি। আসলে নবজোয়ার যাত্রায় তৃণমূলের পাশে মানুষের সমর্থন দেখে বিজেপি ভয় পাচ্ছে। তাই বিজেপি ওদের ডবল ইঞ্জিন সিবিআই এবং ইডিকে কাজে লাগাচ্ছে আমাদের হেনস্থা করার জন্য। আমাকে যেমন হেনস্থা করা হচ্ছে তেমনই আমার স্ত্রী, পুত্র-কন্যাকেও হেনস্থা করা হচ্ছে।’’
কী বললেন মমতা
রুজিরাকে বৃহস্পতিবার জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটা আমার পারিবারিক ব্যাপার। দয়া করে এ বিষয়ে আমায় কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। ও ভাল মেয়ে। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে এবং শান্ত মেয়ে। ও নিজে বলবে নিজের কথা।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy