রাজ্যের আপ নেতারা বলছেন, মহাভারতের সঞ্জয় যেমন যুদ্ধের বিবরণ শুনিয়েছিলেন তেমনই বাংলায় ভোট-যুদ্ধের প্রস্তুতির বিবরণ এই নেতার কাছে থেকেই শুনতে চান কেজরীবাল। সেই দায়িত্ব পাওয়ার পরে রাজ্যে জমি যাচাই করতে সঞ্জয়ের এই বঙ্গ সফর। দক্ষিণবঙ্গ সেরে উত্তরের দিকে রওনা হওয়ার আগে কথা বললেন আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সবাই যেমনটা ভাবছে, তেমনটা হবে না। আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে রাজ্যের সর্বত্র আম আদমি পার্টি (আপ) ভোটে লড়বে বলে যে রটনা তা আদৌ ঠিক নয়। আপাতত অরবিন্দ কেজরীবালের দলের নীতি, যেখানে সংগঠন গড়া যাবে, শুধু সেখানেই ভোটের লড়াই। বাকি জায়গায় দর্শকের ভূমিকায় থাকবে আপ। তৃতীয় বা চতুর্থ স্থানে থেকে হাসির পাত্র হবে না। মধ্য কলকাতার এক কফি শপে বসে বাংলায় আপের নীতি স্পষ্ট করলেন দলের পশ্চিমবঙ্গের পর্যবেক্ষক সঞ্জয় বসু। রাজ্যের আপ নেতারা বলছেন, মহাভারতের সঞ্জয় যেমন যুদ্ধের বিবরণ শুনিয়েছিলেন তেমনই বাংলায় ভোট-যুদ্ধের প্রস্তুতির বিবরণ এই নেতার কাছে থেকেই শুনতে চান কেজরীবাল। সেই দায়িত্ব পাওয়ার পরে রাজ্যে জমি যাচাই করতে সঞ্জয়ের এই বঙ্গ সফর। দক্ষিণবঙ্গ সেরে উত্তরের দিকে রওনা হওয়ার আগে কথা বললেন আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে।
প্রথমে অন্না হাজারে এবং পরে অরবিন্দ কেজরীবালের নীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন সঞ্জয়। পরে চাকরি ছেড়ে দলের সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে যান। পঞ্জাবের বিধানসভা নির্বাচনে আপের দায়িত্ব পালন করা সঞ্জয় এখন পশ্চিমবঙ্গে সংগঠন মজবুত করার নির্দেশ পেয়েছেন। পঞ্জাবে ক্ষমতা দখল এবং গোয়ায় খাতা খোলার পরে আপকে নিয়ে আগ্রহ তৈরি হয় বাংলাতেও। আর সেই আগ্রহকে সাংগঠনিক শক্তিতে বদলে দেওয়াই আপের প্রাথমিক লক্ষ্য বলে জানালেন সঞ্জয়। তিনি বললেন, ‘‘আমরা এখনই ভোটে লড়াইয়ের কথা ভাবছি না। আসলে সংগঠন না থাকলে ভোটে লড়ে কোনও লাভ হয় না। বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা অংশ নেব। তবে সর্বত্র নয়। আমাদের নীতি, যেখানে লড়াই করার মতো সংগঠন তৈরি করা যাবে, সেখানেই প্রার্থী দেওয়া যাবে। আবার শুধু সংগঠন তৈরি হলেই হবে না, পঞ্চায়েত স্তরেও আমাদের প্রার্থী বাছাইয়ের নির্দিষ্ট কিছু মাপকাঠি থাকবে।’’
কিন্তু কী ভাবে তৈরি হবে সংগঠন? জবাবে সঞ্জয় বলেন, ‘‘আসলে সাফল্য না পেলে তার উপরে কারও আগ্রহ তৈরি হয় না। আগেও বাংলায় আমাদের সাংগঠনিক কাঠামো ছিল। সমর্থকও ছিলেন। কিন্তু গত ১০ মার্চ পঞ্জাবের ফল প্রকাশের পরে মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। এখন আগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কর্মী বাছাই পর্ব শুরু হয়েছে।’’ কর্মী বাছাই নিয়ে তাঁরা অনেক কড়াকড়ি করছেন জানিয়ে সঞ্জয় বলেন, ‘‘২০২০ সালে প্রথমে বাংলায় সদস্য সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। মিসড কলের মাধ্যমে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন হাজার পঞ্চাশেক মানুষ। এর মধ্যে মাত্র ১,৭০০ জনের মতো কর্মী হতে পারেন। এ বার তো লাখ লাখ মানুষ মিসড কল দিয়েছেন। এখনও পর্যন্ত তার মধ্য থেকে বাছা হয়েছে ২১ হাজার জনকে। তাঁরা সদস্য হয়েছেন। জেলা ও বিধানসভা স্তরের তালিকা তৈরি হয়ে গিয়েছে। এ বার ওই কর্মীরা পঞ্চায়েত স্তরে সংগঠন গড়ার কাজ শুরু করে দিয়েছেন।’’
সত্যিই কি বাংলায় এত কাজ শুরু করে দিয়েছে আপ? এখনও পর্যন্ত তো সে ভাবে উপস্থিতিই দেখা যাচ্ছে না। অভিযোগ মানলেও এটাই তাঁদের দলের নীতি বলে দাবি করলেন সঞ্জয়। বললেন, ‘‘যে কোনও রাজ্যে আপের উত্থানের পিছনে এটাই ছিল পদ্ধতি। আমরা গেরিলা পদ্ধতিতে বিশ্বাস করি। চুপচাপ সংগঠন গড়ে তোলাই আমাদের নীতি।’’ তবে কি আপনারা, ‘চুপচাপ ঝাঁটায় ঝাঁপ’ নীতি নিয়েছেন? সঞ্জয়ের জবাব, ‘‘এটা বলতেই পারেন। আসলে মানুষের খুবই আগ্রহ আপকে নিয়ে। কিন্তু বাংলার অন্য রাজনৈতিক দলের মতো নই আমরা। এখানে পাওয়ার কিছু নেই, সবটাই দেওয়ার। সেটা সকলকে বোঝানো আমাদের প্রথম কাজ। আমরা চাই না দলের ভিতরে বগটুই-কাণ্ডের মতো কোনও আনারুল হোসেন থাকুন।’’
আপ এই রাজ্যে নির্বাচন লড়তে চাইছে কিন্তু বগটুইয়ের মতো ঘটনাতেও দলকে রাস্তায় দেখা গেল না কেন? একটা নিন্দাসূচক বিবৃতি দেওয়া ছাড়া কিছুই করা হয়নি। সঞ্জয়ের বক্তব্য, ‘‘বগটুই নিয়ে আমরা কার জন্য পথে নামব? দু’দল দুর্নীতিপরায়ণ মানুষের মধ্যে লড়াই। সাধারণ মানুষের মৃত্যু এবং নৃশংসতা নিন্দনীয়। কিন্তু আমরা তো রাজনীতি করতে আসিনি। আমরা রাজনীতি বদলাতে চাই। সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে এটাই আমরা আগ্রহীদের বোঝাতে চাই।’’ বাংলায় এখন তবে আপনারা কী কী করবেন? ‘‘এখন আমাদের পাঁচটা কাজ। প্রথমে জুন মাসের মধ্যে পঞ্চায়েত স্তরে কর্মীদের টিম বানাতে হবে। এর পরে দেখে নিতে হবে যাঁরা ঘনিষ্ঠ হলেন তাঁদের পুরনো রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিচয় স্বচ্ছ কি না। সেই সঙ্গে কাজের লোক কি না দেখা হবে। তৃতীয় স্তরে আমরা জেলা অনুযায়ী স্থানীয় সমস্যা খুঁজে বার করব। চতুর্থ কাজ সমাধানের উপায় ঠিক করা। অরবিন্দ কেজরীবাল বলেন, যেখানে সমস্যা রয়েছে তার আশেপাশেই থাকে সমাধান। আর সব শেষে পঞ্চম দফায় সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে আমরা বলব, আমরা কী করতে চাই। কাজের গ্যারান্টি দিয়ে তবেই সমর্থন চাইব,’’— বলছেন সঞ্জয়।
কিন্তু কার বিরুদ্ধে হবে লড়াই? জাতীয় রাজনীতিতে আপের প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি। দেশে দ্বিতীয় হতে প্রতিপক্ষ কংগ্রেস। বরং, অতীতে তৃণমূলের সঙ্গে আপের ঘনিষ্ঠতা দেখা গিয়েছে। বাংলায় প্রধান শত্রু কারা হবে তা নিয়ে যে আপের মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব রয়েছে তার আভাস মিলল সঞ্জয়ের কথায়। বললেন, ‘‘নীতিগত ভাবে আমরা বিজেপি-র বিরোধী। গোটা দেশে আমাদের লড়াই চলছে। কিন্তু বাংলায় বিজেপি-র তেমন শক্তি নেই। বরং, এখানে মানুষ তৃণমূলের দুর্নীতির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তাই বাংলায় মূল লড়াইটা হবে শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে বাংলার মানুষকে বোঝাতে হবে যে, তৃণমূলের বিকল্প বিজেপি হতে পারে না।’’
বাংলায় সংগঠন তৈরি থেকে পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়াই— লক্ষ্য যাই থাকুক না কেন, সঞ্জয়ের কথায় একটা বিষয় স্পষ্ট যে, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের মতো মুখ পোড়াতে রাজি নয় কেজরীবালের দল। সে বার বাংলায় সমর্থন মিলবে বলে রাজ্যের চারটি আসন— উত্তর কলকাতা, হাওড়া, রায়গঞ্জ এবং ব্যারাকপুরে প্রার্থী দিয়েছিল আপ। কিন্তু শুধু শূন্য হাতে ফেরাই নয়, কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি আপ। আর সেই ভুল না করে ‘আগে সংগঠন, পরে নির্বাচন’ নীতি নিয়েই এগোতে চায় ঝাড়ু শিবির। কলকাতায় দফতর বানাতে ভাড়াবাড়ির খোঁজ চালানো হলেও সাংগঠনিক চেহারা কিছুটা মজবুত হওয়ার আগে স্থায়ী ঠিকানা বানাতেও চাইছে না দিল্লি ও পঞ্জাবের শাসক দল। ঢাকঢোল পেটানো প্রচারও নয়। কথাবার্তার শেষে সঞ্জয় মানলেন, আপাতত ‘চুপচাপ ঝাঁটায় ঝাঁপ’ই বঙ্গ-আপের নীতি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy