সকাল হলেই ছেলে তাহাজুলকে নিয়ে গ্রাম থেকে ইঞ্জিন-ভ্যান ভর্তি করে কর্কটক্রান্তি রেখার ফলকের কাছাকাছি ডাব বিক্রি করতে চলে আসেন আনারুল হক (বাঁ দিকে)। রোজ। — নিজস্ব চিত্র।
শনিবারের বারবেলা! দাঁড়িয়ে রয়েছি কর্কটক্রান্তি রেখার উপরে। গা ঘেঁষে রংচটা ফলক। সেখানে লেখা ‘ইউ আর ক্রসিং ট্রপিক অফ ক্যানসার’।
আমি যদিও ‘কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম’ করলাম না। কর্কটক্রান্তি রেখায় গরম কেমন, তা দেখতে এসেছি। অতএব অদৃশ্য সেই রেখার উপরেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। ১২টা বেজেছে সবে। সূর্য একেবারে যাকে বলে, মধ্যগগনে! গনগন করছে। মনে হল, আগুনে-হলকা লাগছে। শুনেছি, কর্কটক্রান্তি রেখা গিয়েছে বলে নদিয়া জেলায় গরম বেশি। বিশেষত জেলাসদর কৃষ্ণনগরে। সেই সূত্রেই দেখতে আসা, এই গরমে কেমন উত্তপ্ত থাকে খোদ কর্কটক্রান্তি রেখা!
কৃষ্ণনগর শহর থেকে মাত্র সাড়ে চার কিলোমিটার দূর দিয়ে গিয়েছে কর্কটক্রান্তি রেখা। ভৌগোলিক কারণেই কৃষ্ণনগরে গরমকালে গরম আর শীতকালে শীত বেশি পড়ে। প্রায় ১৫৩ হেক্টর এলাকা জুড়ে-থাকা বাহাদুরপুর জঙ্গলে কয়েক ঘণ্টা কাটালেও শোনা গেল না পাখিদের পরিচিত কিচিরমিচির। বৃষ্টির অভাবে গাছগুলো শুষ্কপ্রায়। অভিজ্ঞ এক বনকর্মী যেমন বলছিলেন, ‘‘পাখি থেকে শুরু করে বন্যপ্রাণী— সবাই গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ফরেস্টের ভিতরে ঝিলের পাড়ে গাছগুলোয়। সকালের দিকে কিছু আনাগোনা হলেও দুপুর গড়ালে পাখিরাও আর কর্কটক্রান্তি রেখার পথ মাড়ায় না।’’
কর্কটক্রান্তি রেখা পৃথিবীর মানচিত্রে অঙ্কিত প্রধান পাঁচটি অক্ষরেখার মধ্যে একটি। এটি নিরক্ষরেখা থেকে উত্তরে অবস্থিত এবং ২৩ ডিগ্রি ২৬ মিনিট ২২ সেকেন্ড অক্ষাংশ বরাবর কল্পিত একটি রেখা। বছরে সূর্য এক বার নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে উত্তর গোলার্ধের সর্বশেষ যে স্থান পর্যন্ত পরিক্রমা করে আবার নিরক্ষরেখার দিকে ফিরে আসে, সেই কাল্পনিক রেখাটিকে কর্কটক্রান্তি রেখা বলে। ২১ জুন সূর্য নিরক্ষরেখার উপর লম্ব ভাবে অবস্থান করায় দিন বড় এবং রাত ছোট হয়। কর্কটক্রান্তি রেখা ১৭টি দেশের উপর দিয়ে গিয়েছে। এটিই একমাত্র অক্ষরেখা যা ভারতের উপর দিয়ে গিয়েছে। ভারতের মোট ৮টি রাজ্যের উপর দিয়ে গিয়েছে কর্কটক্রান্তি রেখা— গুজরাত, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও মিজোরাম। ২১ জুনের ঠিক চার দিন আগে, শনিবার, কৃষ্ণনগরের কাছে কর্কটক্রান্তি রেখায় দাঁড়িয়ে গরমের পাশাপাশি অন্য রকম একটা অনুভূতিও হল।
কৃষ্ণনগর-লালগোলা শাখার বাহাদুরপুর স্টেশন ডান দিকে রেখে হাঁসাডাঙা বিল। সেটা পেরিয়ে ৫০ মিটার এগোতেই বাহাদুরপুর জঙ্গল। তার ঠিক মাঝামাঝি অংশে প্রায় চটে যাওয়া রঙে লেখা ফলক। উত্তর গোলার্ধের উষ্ণতার অন্যতম ভরকেন্দ্র এই ‘কর্কটক্রান্তি রেখা’। শনিবার যেখানে তাপমাত্রা ছিল ৩৮.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি সপ্তাহের ‘শীতলতম দিন’। বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ ৬০ শতাংশের বেশি। ফলে ভ্যাপসা আর প্যাচপ্যাচে গরম। বেজায় অস্বস্তি। মাঝেমাঝে ভেসে-আসা কয়েক খণ্ড মেঘ সেই অস্বস্তি বাড়িয়েছে কয়েক গুণ।
হাঁসাডাঙা বিল পেরিয়ে এক জনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কর্কটক্রান্তি রেখাটা কোথায়? কলেজশিক্ষক নীতীশ বিশ্বাস এই পথের নিত্যযাত্রী। চিনিয়ে দিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘‘বাহাদুরপুর থেকে গরম শুরু হয়। কৃষ্ণনগরেও প্রচণ্ড গরম। এখানে পৌঁছলে আলাদা করে বলে দিতে হয় না, কর্কটক্রান্তি রেখার উপরে আছি। আবহাওয়াই আপনাকে বুঝিয়ে ছাড়বে!’’ বাহাদুরপুর জঙ্গলের ঠিক মাঝামাঝি দিয়ে গিয়েছে কর্কটক্রান্তি রেখা। কাল্পনিক সেই পথের উপরেই মায়াকোল ফরেস্ট অফিস। ছায়াঘেরা অফিসের গাছের তলায় খাটিয়া নিয়ে আদুল গায়ে বসে রয়েছেন তিন বনরক্ষী। এক জন ষাট ছুঁই-ছুঁই। নাম তপন সর্দার। বাঁকুড়া থেকে বদলি হয়ে বেশ কয়েক বছর আগে এসেছেন এখানে। প্রতি বছর কর্কটক্রান্তি রেখার বাড়তি গরমে অভ্যস্ত হলেও এ বছর যেন নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা! দিনে তো বটেই, এমনকি রাতেও চোখের পাতা এক করতে পারছেন না গরমের দাপটে। তপনের কথায়, ‘‘দিন-রাত কী ভাবে যে কাটাচ্ছি সে আর বলার মতো না। আগে কোনও বার এত কষ্ট হয়নি। এ বার যেন মনে হচ্ছে, সূর্য কিছুটা এগিয়ে এসেছে আমাদের দিকে।’’
গরম যে এ বার বেশ খানিকটা বেশি, তা এলাকার সকলেই বলছেন। ফলকের উল্টো দিকেই ১২ নম্বর জাতীয় সড়কের বহরমপুরগামী লেনের পাশে ধুবুলিয়ার বাসিন্দা নেপাল কর্মকারের গ্রিল কারখানা। কথায় কথায় তিনি বলছিলেন, ‘‘প্রায় সাত বছর হয়ে গেল এখানে দোকান করেছি। অনেক গরম পেরিয়েছি। তবে এমন তাপ আগে কখনও গায়ে লাগেনি! বাইরে বেরোলেই মুখ পুড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে স্ট্রোক হয়ে যাবে।’’
স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, মায়াপুর-নবদ্বীপ যাওয়ার পথে অনেক পর্যটকই দাঁড়ান বাহাদুরপুরের জঙ্গলে। গরমেও সেই সংখ্যা খুব একটা কমে না। তবে এ বার কমেছে কিছুটা। স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ী অভীক চৌধুরী বলছেন, ‘‘বেথুয়াডহরি ফরেস্ট আর মায়াপুরে প্রচুর পর্যটক আসেন। গরমের ছুটির মরসুমেও গত বার ভাল ভিড় হয়েছিল। অসহনীয় গরমে এ বার পর্যটকের সংখ্যা কম।’’ প্রাক্তন বিজ্ঞান শিক্ষক আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বাহাদুরপুর এলাকারই বাসিন্দা। নবতিপর আশিসবাবু বললেন, ‘‘কর্কটক্রান্তি রেখার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের উপরে দেখলাম জঙ্গলটাকে আস্তে আস্তে ছোট হতে। কংক্রিটের জঙ্গলে এর থেকে বেশি আর কী আশা করতে পারি! জীবদ্দশায় এ রকম গরম দেখিনি।’’
তবে এঁদের মধ্যে আনারুল হকও ছিলেন। সকাল হলেই ছেলেকে নিয়ে গ্রাম থেকে ইঞ্জিন-ভ্যান ভর্তি করে কর্কটক্রান্তি রেখার ফলকের কাছাকাছি ডাব বিক্রি করতে চলে আসেন। রোজ। তাঁর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ্য অন্য রকম। বছর চল্লিশের আনারুল জানাচ্ছেন, কর্কটক্রান্তির বাড়তি গরমে ডাবের চাহিদাও প্রচুর। বাড়তি গরম পড়লে দু’পয়সা বাড়তিই রোজগার হয়। সে জন্য গ্রাম থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে গোটা দিনটা এখানেই থাকেন। আনারুল বলেন, ‘‘কষ্ট হচ্ছে ঠিকই। তবে গরম থাকুক না আর ক’টা দিন। পয়সা ইনকামের এটাই তো সময় আমাদের।’’
কেন কর্কটক্রান্তি রেখার উপরেই বসেন ডাবের পসরা নিয়ে? আনারুলের ছেলে তাহাজুল জবাব দিলেন, ‘‘বোর্ডটা দেখলে মানুষের একটু বেশি গরমের কথা মনে পড়ে। বাইরের লোকজন দাঁড়ায়। ছবি তোলে। সেই ফাঁকে আমাদের ডাব বিক্রি হয়।’’
কারও গরমে নাভিশ্বাস। আনারুলের জ্যৈষ্ঠ মাস!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy