ভ্যাপসা গরমে কাহিল অবস্থা সাধারণ মানুষের। —ফাইল চিত্র।
সকাল ১০টা বাজতেই শনিবার দোকান বন্ধ করে দিয়েছিলেন মিলন শীট। বাঁকুড়া শহরের মাচানতলায় তাঁর রেডিমেড পোশাকের দোকান। গত কয়েক দিন ধরেই অসহনীয় গরম। কিন্তু শনিবার সহ্যের সব সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে জানালেন মিলন। তাই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন সকালেই।
পুরুলিয়া শহরে টোটো চালান অমিত প্রামাণিক। বাড়ি পুরুলিয়ারই খেজুরাডাঙায়। শনিবার সকালের দিকে বেরিয়েছিলেন টোটো নিয়ে। কিন্তু গরমের হলকায় বেশি ক্ষণ আর রাস্তায় থাকতে পারেননি। ১০টার আগেই বাড়ি চলে গিয়েছিলেন টোটো-সহ।
একই অবস্থা কানাই মোদকের। পুরুলিয়া শহরের নাপিতপাড়ায় বাড়ি তাঁর। মধ্যবাজারে একটি চা-দোকান রয়েছে। শনিবার সকালের দিকে কয়েক জন খদ্দের এসেছিলেন। তার পর থেকে মাছি-তাড়ানো অবস্থা। তার সঙ্গে উনুনের তাপ। দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে সাড়ে ১০টা বাজার আগেই বাড়ি চলে গিয়েছেন কানাই।
স্থানীয়েরা বলছেন, এ বার বাঁকুড়ার গরমের সঙ্গে পুরুলিয়ার গরমের ফারাক রয়েছে। বাঁকুড়ায় এত দিন ঠা-ঠা গরম পড়ত। ঘাম হত না। এ বার বাতাসে জলীয় বাষ্প বেশি থাকায় ঘাম হচ্ছে। ফলে ৪২-৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বাড়তি অস্বস্তি ঘাম। এমনিতেই রাস্তায় রোদের তাপে বেরোনো যাচ্ছে না, তার সঙ্গে এই আর্দ্রতা আরও অস্বস্তির কারণ হয়েছে। শনিবার বাঁকুড়ার তাপমাত্রা ছিল ৪০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাভাবিকের চেয়ে যা ০.৫ ডিগ্রি বেশি। মিলন বলছিলেন, ‘‘এত দিন সকালে দোকান খুলতাম। বেলা বাড়তে দোকানের সামনে একটা কাপড়ের সামিয়ানা মতো টাঙাতাম। তাতে অন্তত রোদের হলকা থেকে বাঁচা যেত। আজ কোনও কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। একটু সময় বসেই ১০টার মধ্যে দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে এসেছি। কোনও ভাবেই বসে থাকতে পারছিলাম না। শরীর খারাপ লাগছিল।’’
পুরুলিয়ায় বাতাসে যদিও আর্দ্রতার পরিমাণ অতটা নয়। রোদ্দুরের তেজই বাইরে বেরোতে দিচ্ছে না লোকজনকে। শনিবার পুরুলিয়ার তাপমাত্রা ছিল ৪৩.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। স্বাভাবিকের চেয়ে যা প্রায় ৯ ডিগ্রি বেশি। অমিতের কথায়, ‘‘টোটোর ছাউনি আছে। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হচ্ছে না। রাস্তায় টোটো নিয়ে ঘুরছিলাম সকাল থেকে। একটু পর থেকেই মনে হচ্ছিল, কামারশালায় বসে রয়েছি। এত গরম! জেলায় প্রতি বারই গরম পড়ে। কিন্তু এ বার যেন সহ্য করতে পারছি না।’’ কানাইও বলছিলেন, ‘‘চায়ের দোকান তো। উনুন আর গরম জল নিয়ে কারবার। আজ আর সহ্য করতে পারছিলাম না।’’
মিলন, অমিত, কানাইরা আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাসের কথা শুনেছেন। জানতে পেরেছেন, আগামী কয়েক দিন রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলিতে তাপপ্রবাহ চলবে। ফলে গরম যে এখনই কমার কোনও লক্ষণ নেই, তা-ও বিলক্ষণ জানেন তাঁরা। তাই আগামী কয়েক দিন সকাল-সকাল কাজকর্ম সেরে ১০টার আগেই বাড়ি ঢুকে যেতে চান।
আলিপুর আবহাওয়া দফতর আগামী দু’দিন দক্ষিণবঙ্গের ৯টি জেলায় তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করেছে। সোমবারও ৭টি জেলায় তাপপ্রবাহের সম্ভাবনা রয়েছে, বাকি জেলায় আর্দ্রতাজনিত অস্বস্তি বজায় থাকবে। একই সঙ্গে দক্ষিণের সব জেলায় বিক্ষিপ্ত ভাবে বৃষ্টির সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছে তারা। মঙ্গলবার থেকে দক্ষিণবঙ্গে তাপপ্রবাহের সতর্কতা আর থাকছে না। ২-৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমার সম্ভাবনাও রয়েছে। সব জেলাতেই বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির সম্ভাবনা বাড়বে।
দক্ষিণবঙ্গে এখনও ‘বর্ষা’ ঢোকেনি খাতায়কলমে। তবে উত্তরবঙ্গে ঢুকেছে। কিন্তু বর্ষা ঢুকলেও সেখানে তেমন বৃষ্টি হচ্ছে না। উত্তরবঙ্গের উত্তর ভাগের জেলাগুলিতে তা-ও যদিও বা কিছুটা বৃষ্টি হচ্ছে বিক্ষিপ্ত ভাবে, দক্ষিণ ভাগের জেলাগুলি একেবারেই শুকনো। উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ— শনিবারের পূর্বাভাসেও উত্তরবঙ্গের দক্ষিণ ভাগে তাপপ্রবাহের কথা বলা হয়েছে। তবে উত্তর ভাগের দার্জিলিং, কালিম্পংয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহারে ততটাও বৃষ্টি হচ্ছে না। হলেও বিক্ষিপ্ত ভাবে। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, ওই পাঁচ জেলায় আগামী কয়েক দিন ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কলকাতায় গত কয়েক দিন ঠা-ঠা রোদ্দুরের পর শনিবার কিছুটা হলেও স্বস্তি মিলেছে। তাপমাত্রা কিছু কমেছে। শুক্রবার যেখানে দুপুরের দিকে রাস্তাঘাট সুনসান হয়ে গিয়েছিল, শনিবার সেখানে কোনও গরম হাওয়া ছিল না। বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিমাণ কিছুটা হলেও কম ছিল। শনিবার কলকাতার তাপমাত্রা ছিল ৩৫.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রোজ বাসে করে বাগুইআটি থেকে ধর্মতলার অফিসে আসেন অভীক রায়। তাঁর কথায়, ‘‘শুক্রবার এক ঘণ্টার পথ বাসে ৩৫ মিনিটে চলে এসেছিলাম। কন্ডাকটর বলেছিলেন, চালক গরমে পেরে উঠছেন না। বাইরের গরম, ইঞ্জিনের গরম, সব মিলিয়ে কাহিল হয়ে পড়ছেন। তাই টেনে চলে এসেছেন। শনিবার কিন্তু পরিস্থিতি একটু সহনীয় লেগেছে।’’
উত্তরের হাতেগোনা কয়েকটি জেলা বাদ দিয়ে বাকি রাজ্য পুড়ছে। কোথাও প্রবল তাপ। কোথাও জলীয় বাষ্পের পরিমাণ এতটাই বেশি যে, অস্বস্তি চরমমাত্রা ছাড়ানোর উপক্রম করেছে। উত্তরবঙ্গের উত্তর ভাগের পাঁচ জেলার মধ্যে মাত্র দু’টিতেই বিক্ষিপ্ত ভাবে বৃষ্টি হচ্ছে— দার্জিলিং ও কালিম্পং। পাহাড়ের এই দুই জেলা বাদ দিয়ে বাকি তিনটিতে তেমন ভাবে বৃষ্টি হচ্ছে না। কোচবিহারের আকাশ যেমন শনিবার সকাল থেকেই মেঘলা। গত তিন দিন ধরে বিক্ষিপ্ত ভাবে বৃষ্টি হলেও শনিবার এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি সেখানে। একই অবস্থা আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ির। উত্তরবঙ্গের দক্ষিণ ভাগের তিন জেলা উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের কোনও ফারাক নেই। এখনও পর্যন্ত বৃষ্টির দেখা মেলেনি দুই দিনাজপুরে। উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস মাঝিয়ান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শনিবার বেলা ১২টা নাগাদ তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু অনুভূত হচ্ছে প্রায় ৪২ ডিগ্রির মতো। তার কারণ, বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ ওই সময়ে ছিল প্রায় ৬৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা। মালদহের পরিস্থিতিও একই রকম। সকাল থেকেই কড়া তাপ। সঙ্গে দমকা গরম হাওয়া। শনিবার দুপুর ১২টা নাগাদ মালদহ শহরের তাপমাত্রা ছিল ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সকাল থেকে এক ফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি।
দক্ষিণবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও নদিয়ায় যদিও আগের কয়েক দিনের তুলনায় শনিবার একটু কম গরম অনুভূত হয়েছে। তবে তাপমাত্রা কিছুটা কম হলেও আর্দ্রতা বেশি থাকায় অস্বস্তি বেশি ছিল। সকালের দিকে সামান্য ঝোড়ো হাওয়া ও মেঘলা আকাশ থাকলেও বেলা বাড়তেই চড়া রোদ্দুর। তাপপ্রবাহ চলেছে দিনভর। রাস্তাঘাট সুনসান। অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের কারণে জেলা স্বাস্থ্য দফতরের উদ্যোগে নদিয়ায় রাজ্য সড়কে ‘ওআরএস’ বিতরণ করা হয়েছে। তবে বেলা তিনটের পর থেকে আবার মেঘ জমতে শুরু করে। চারটে নাগাদ শুরু হয় ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি। মিনিট চল্লিশ টানা বৃষ্টি হয় মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া জেলার উত্তর অংশে। উত্তরেও শুরু হয়েছে বৃষ্টি।
হুগলিতে গত কয়েক দিন তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির উপরে ছিল। তুলনায় শনিবার কিছুটা কম। তাপমাত্রা ৩৮.৫ ডিগ্রি হলেও গরমের অনুভূতি ৫০ ডিগ্রি। তারকেশ্বর, ধনেখালি, দাদপুর এলাকায় বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়েছে শুক্রবার। শনিবার সকালেও মেঘ ছিল। ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়েছে চুঁচুড়া ও চন্দননগরে। বেলার দিকে বলাগড়েও বৃষ্টি হয়েছে। তবে সে ভাবে হয়নি। বেলা বাড়তেই সূর্যের তেজে পুড়েছে গোটা জেলা। পূর্ব মেদিনীপুরেও শনিবার সকাল থেকে আংশিক মেঘলা আকাশ ছিল। মৃদুমন্দ বাতাসও ছিল। বেলা ১টা নাগাদ দিঘা এলাকায় সামুদ্রিক বাতাস খানিকটা গতি পেয়েছে। গত কয়েক দিনের থেকে তাপমাত্রা কিছুটা কমলেও ভ্যাপসা গরমে কাহিল অবস্থা সাধারণ মানুষের। দিঘা, রামনগর, কাঁথি, হলদিয়া, তমলুক, মেচেদা— সর্বত্রই এক ছবি। বর্ধমানেও ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। পারদ প্রতি দিন ৪২ থেকে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে দাঁড়িয়ে। বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকায় অস্বস্তি ছিল শনিবার। বেলা বাড়তেই রাস্তাঘাট সব সুনসান। দুপুরের দিকে ‘লু’ বইছে। শনিবারও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল।
পশ্চিম বর্ধমানের শিল্পাঞ্চলের অবস্থাও একই। শনিবারও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ ডিগ্রি ছিল। খুব প্রয়োজন ছাড়া সাধারণ মানুষ বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছেন না। আসানসোল আদালতের আইনজীবীরা গরমে আদালতে না আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফলে আদালত বন্ধ। বেশ কিছু স্কুল সকালে হচ্ছে। উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়নি। জেলার বিভিন্ন রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে লেবু জল আর গ্লুকন-ডি’র জল বিতরণ করছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ। ট্রেনযাত্রীরা তাতে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন। অন্য দিকে, হাওড়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের অবস্থাও একই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy