আদর: পিলি কোঠির মঞ্জুনানির সঙ্গে নাগমা। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
হাওড়ার বাখরা কবরপাড়া বাজারের পাশে একটা সরু গলি। সেই গলির শেষ প্রান্তে দোতলা ‘পিলি কোঠি’-তে নানি আর মাসিদের সঙ্গে থাকে নাগমা আর রাহুল। নাগমার ছয় পূর্ণ হলো আর রাহুল পনেরো ছুঁইছুঁই। তারা খুনসুটি করে। বেড়াতে যায়। পড়াশোনা করে। বকুনিও খায়। আদরে-শাসনে, মিঠে-কড়ায় দিন কাটে আর-পাঁচটা বাচ্চার মতোই।
অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে নাগমা-রাহুলের তফাত করে শুধু বাইরের লোকজন। একটি ফুটফুটে শিশুকন্যা আর এক সপ্রতিভ কিশোর হিজড়েদের আশ্রয়ে বড় হচ্ছে শুনে কেউ চমকে ওঠেন। কেউ কেউ অবাক হন। কারও বা কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ: ‘ইস! বাচ্চা দু’টোকে ওরা না আবার ওদের মতো করে নেয়!’
কিন্তু তাঁদের যাবতীয় আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে পিলি কোঠির নানি-মাসিদের আশ্রয়ের শক্ত গুঁড়িটাকে লতানে গাছের মতো আরও বেশি করে জড়িয়ে তরতরিয়ে, ঝলমলিয়ে বেড়ে উঠছে এক শৈশব এবং এক কৈশোর। আর এই দুই নবীন জীবনের ভিতর দিয়ে নিজেদের না-পাওয়া ইচ্ছেগুলোকে মুঠোবন্দি করার চেষ্টা করতে থাকেন সমাজের প্রান্তবাসীরা।
অভাবের জ্বালায় সন্তানকে মানুষ করতে না-পেরে বাখরার হিজড়েদের হাতেই নাগমা আর রাহুলকে তুলে দিয়েছিল তাদের পরিবার। তার পরে আর যোগাযোগও রাখেনি। এই সামাজিক উলটপুরাণে ব্রাত্যদের দ্বারস্থ হয়েছে সমাজের মূল স্রোত।
‘আংরেজি বোলনেওয়ালা বড়া আদমি’ বানানোর স্বপ্নে শিশু দু’টিকে বুকে আগলে মানুষ করছেন হিজড়েরাই। মহেশ ভট্টের ‘তমন্না’র টিক্কু, কল্পনা লাজমির ‘দরমিয়াঁ’র ইম্মির মতো বৃহন্নলাদের নিয়ে রিল-লাইফের ‘রিপ্লে’ এখন রিয়েল লাইফে। অর্থাৎ বাখরার বাস্তবে। এলাকার নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে নাগমা এখন ক্লাস ওয়ানে আর রাহুল ক্লাস এইটে। দু’জনকে বাড়িতে পড়ানোর জন্য রয়েছেন একাধিক গৃহশিক্ষক। তাদের ঘুম থেকে উঠিয়ে পড়তে বসানো, টিফিন করানো, স্কুলে নিয়ে যাওয়া-ফিরিয়ে আনা— পালা করে সব করেন বাড়ির মাসিরাই।
পিলি কোঠির একতলার বড় হলঘরে বাড়ির প্রধান ‘মঞ্জু হিজড়ে’-কে ঘিরে বসে ছিলেন লিলি, রাধিকা, অপর্ণা, সনিয়া, বৃষ্টি, কাশ্মীরা, কিরণ, টুম্পা। তাঁদের মাঝখানে হুটোপাটি করছিল নাগমা। আর এক কোণে লাজুক হাসি নিয়ে বসে রাহুল। মঞ্জু বলেন, ‘‘চিরদিন লোকে তো আমাদের ঘেন্নাই করল। এখন এই বাচ্চা দু’টোই আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। এরা পড়ালিখা করে বড়া আদমি হয়ে যাক। আর কিছু চাই না।’’
মঞ্জু জানালেন, সোনারপুরের মল্লিকপুরে তাঁদের সম্প্রদায়ের একটা বৈঠকে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। গ্রামের একটি হতদরিদ্র পরিবারে পাঁচটি মেয়ে ছিল। মঞ্জুরা সেখানে থাকাকালীন জন্ম হয় ছ’নম্বর মেয়ের। মানুষ করতে পারবেন না বলে সেই এক দিনের মেয়েকে তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন বাবা-মা। সেই মেয়েই নাগমা। একই ভাবে চার বছরের রাহুলকে তাঁদের হাতে সঁপে দিয়েছিল পিলখানার একটি পরিবার।
সেই রাহুল এখন বলে, ‘‘এঁরাই আমার বাবা। এঁরাই মা। আমার স্কুলের বন্ধুদেরও আমি সব কিছু জানিয়ে দিয়েছি। জানিয়েছি, আমি এই বাড়িতে থাকি। তারা কেউ আমাকে দুয়ো দেয়নি। বরং অনেক বার আমার বাড়িতে এসেছে।’’ থেমে থাকার পাত্রী নয় নাগমাও। ‘‘আমি বড় হয়ে ডাক্তার হবো। নানির খুব কাশি হয়। আমি সুঁই লাগিয়ে ভাল করে দেবো,’’ নানির কোল ঘেঁষে বসে বলে ওঠে নাগমা।
মুহূর্তে যেন হাজার ঝাড়বাতি জ্বলে ওঠে বাখরা কবরপাড়ার পিলি কোঠির অন্ধকার ঘরটায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy