ছবি: সংগৃহীত।
নমাজ সেরে ফেজ টুপি হাতে সবেমাত্র মহল্লায় ফিরেছেন তিনি। উঠোনের মতো কাপড় মেলা সরু গলির ধারে সাংবাদিকের সঙ্গে প্রথম মোলাকাতেই তাঁর ঝাঁঝালো সংলাপ— ‘‘খুদার কসম, এই এলাকায় দাঙ্গা-ফ্যাসাদ হতে দেব না। হিন্দুদের জান নিতে হলে, আগে আমাদের জান নিতে হবে।’’
ভাটপাড়া-কাঁকিনাড়া এলাকার জুট মিল অঞ্চলে ভোটের সময় থেকেই লাগাতার হিংসা চলছে। গুলি-বোমার শব্দে দীর্ঘদিন ধরে কার্যত বন্ধ দোকান-বাজার। প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক তথা ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংহ জয়লাভের পরে মাত্রা ছাড়িয়েছে হিংসা। এবং রাজনীতির নিয়ম মেনে তৃণমূল দোষ দিচ্ছে বিজেপিকে। বিজেপি তৃণমূলকে।
রাজনীতি আছে রাজনীতিতে। কিন্তু ভাটপাড়া, কাঁকিনাড়া অঞ্চলে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ। বহু মানুষ ঘর ছাড়া। স্থানীয় মানুষের মুখে চোখে আতঙ্ক।
এমনই এক পরিবেশে স্রোতের উল্টো দিকে হাঁটছে ‘তিন নম্বর গলি’। কাঁকিনাড়ার নয়াবাজার অঞ্চলে জুট মিল বস্তির তিন নম্বর গলিতে হাজার দেড়েক মানুষের বাস। যার অধিকাংশ মুসলিম। হিন্দু মাত্র কয়েক ঘর। ভোট-পর্বে যখন প্রথম গোলমাল শুরু হল এবং মুহূর্তের মধ্যে তা হিংসার চেহারা নিল, আর সকলের মতো দুই এবং তিন নম্বর গলির হিন্দুরাও ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। ঠিক যেমন ভয় পেয়েছিলেন হিন্দু অধ্যুষিত গলির মুসলিমরা। ভেবেছিলেন, যে কোনও সময় আক্রমণ নেমে আসতে পারে তাঁদের উপরেও। ২৩ মে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর আতঙ্কে পালিয়ে গিয়েছিলেন তিন নম্বর গলির দু’-এক ঘর। কিন্তু সেই অস্থির সময়েই এলাকার বাসিন্দা ওয়ারিস আলি, মাকসুদদের নেতৃত্বে তৈরি হয় শান্তি কমিটি। এলাকার সমস্ত মানুষকে নিয়ে বৈঠক করে ওয়ারিসরা ঠিক
করে ফেলেন, নিজেদের প্রাণ গেলে যাবে, কিন্তু প্রতিবেশীদের সুরক্ষিত রাখতেই হবে। সকলকে ফিরিয়ে আনতে হবে ঘরে।
তিন নম্বর গলিতে এখন সকলে সুরক্ষিত। সুরক্ষিত চিলতে গলির ভিতরে কাছাকাছি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা মন্দির আর মসজিদ। ওয়ারিসের কথায়, ‘‘যুগ যুগ ধরে এখানে একসঙ্গে বাস করছি আমরা। ইদে আমার বাড়িতে ওঁরা খেতে আসেন। পুজোয় আমরা যাই ওঁদের বাড়ি। এক দিনে সেই সম্পর্ক ভেঙে দেওয়া যায় না কি? দু’-এক জন যাঁরা পালিয়ে গিয়েছিলেন, দু’-এক দিনে তাঁদের এলাকায় ফিরিয়ে এনেছি।’’
ওয়ারিসের কথাই শোনা যাচ্ছে মায়া দেবী, সুরেশ কেশরীর গলায়। তিন নম্বর আর দু’নম্বর গলির মোড়ে বসবাসকারী মায়া দেবীর দাবি, ‘‘বাকি এলাকায় কী হচ্ছে জানি না, আমাদের এখানে সবাই একসঙ্গে থাকতাম, আছি এবং থাকব। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না।’’ আর সুরেশবাবুর মন্তব্য, ‘‘এ সব হিংসা তো রাজনীতির জন্য হয়। আমরা ও সব গায়ে মাখি না। হিন্দু-মুসলিম সবাই আমরা একসঙ্গে থাকি। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না।’’
কিছু দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘বিজেপিকে জেতালে রাজ্যের দিকে দিকে ভাটপাড়া তৈরি হবে।’’ জবাবে বিজেপির এক রাজ্য নেতা বলেছিলেন, তৃণমূলের ‘তোষণে’র রাজনীতির ফলেই ব্যারাকপুরের এই হাল। প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। গেরুয়া রাজনীতি বলছে, সেখানে হিন্দুরা আক্রান্ত। ঘাসফুল বলছে মুসলিম। আর ওয়ারিস, সুরেশরা বলছেন— আক্রান্ত মানবতা। ব্যারাকপুরের দিকে দিকে ‘তিন নম্বর গলি’ তৈরি না হলে মনুষ্যত্ব আর বাঁচবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy