উত্তম ঠাকুর। — নিজস্ব চিত্র।
মহানায়ক উত্তমকুমারের ছবির একটা সংলাপ যেন মিলে গেল বাস কন্ডাক্টর উত্তমকুমারের জীবনের সঙ্গে।
মিথ্যা অভিযোগে বারো বছর ধরে জেল খাটা বাবাকে ‘সবার উপরে’ ছবিতে বেকসুর মুক্ত করেছিলেন পুত্র উত্তম। বাবা ছবি বিশ্বাস তখন বলেছিলেন, “ফিরিয়ে দাও আমার সেই বারোটা বছর!”
আজ নিজের আঠারোটা বছর ফেরত পেতে চান ভিন্ন উত্তমকুমার। নিজের গা থেকে অপরাধীর তকমা মুছতে যাঁকে লড়াই করতে হয়েছে একাই।
২২৫ টাকার হিসেব মেলেনি। তার জন্য ঝাড়া আঠারোটা বছর শাস্তি ভোগ করে কেটে গিয়েছে উত্তমকুমারের। ক্যালকাটা স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন (সিএসটিসি)-এর বাস কন্ডাক্টর উত্তমকুমার ঠাকুর। সাজানো খুনের মামলায় ছবি বিশ্বাসের চরিত্রটির মতো জেল খাটতে হয়নি। কিন্তু আর্থিক অপরাধের দায় মাথায় নিয়ে কর্মক্ষেত্রে মাথা নিচু করে কাটাতে হয়েছে এতগুলো বছর। হজম করতে হয়েছে কম বেতনের গ্লানি।
সম্প্রতি কলকাতা হাই কোর্টে বিচারপতি পার্থসারথি চট্টোপাধ্যায়ের এজলাসে মিলেছে মুক্তির ফরমান। উত্তমের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খারিজ করে বিচারপতি জানিয়েছেন, ওই অভিযোগ বেআইনি। উত্তমকে আগের বেতন কাঠামোয় ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এত বছর ধরে উত্তম যে সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন, তা-ও তিন মাসের মধ্যে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আদালত সূত্রের খবর, বরাহনগরের বাসিন্দা উত্তম সিএসটিসি-র কাশীপুর ডিপোতে কর্মরত ছিলেন। ২০০৫ সালের শেষের দিকে এক দিন সকালে এক যাত্রীকে খুচরো দেওয়ার জন্য বাসচালকের কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়েছিলেন তিনি। সে দিনই মাঝপথে সিএসটিসি-র অফিসারেরা আচমকা বাসে তল্লাশি চালিয়ে নগদের বাক্সে অতিরিক্ত ২২৫ টাকা পান। তাঁরা ধরে নেন, যাত্রীদের টিকিট না দিয়েই ভাড়া নিয়েছেন উত্তম। খুচরো দেওয়ার জন্য বাসচালকের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কথা জানানো হলেও তা মানতে চাননি অফিসারেরা।
উত্তমের কন্ডাক্টরের ব্যাগ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়। তাঁর বেতন কমিয়ে দেওয়া এবং যাবতীয় সুযোগসুবিধা স্থগিত করে দেওয়া হয়। সিএসটিসি-র চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করেও সুরাহা মেলেনি। ২০০৬-এ উত্তম হাই কোর্টে মামলা করলে আদালত তাঁকে অ্যাপেলেট ট্রাইবুনালে যেতে বলে। কিন্তু ট্রাইবুনাল দফতরের সিদ্ধান্তই বহাল রাখে। ট্রাইবুনালের নির্দেশের বিরুদ্ধে ফের হাই কোর্টে মামলা করেন উত্তম।
উত্তমের আইনজীবী আশিসকুমার চৌধুরী আদালতে দাবি করেন, উপযুক্ত নথি না দিয়ে একতরফা শুনানি করে সিএসটিসি তাঁর মক্কেলকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। ঘটনার সময় উপস্থিত বাসচালককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। আইন ভঙ্গ করে উত্তমের বেতন কমিয়ে দেওয়া হয়। হাই কোর্ট বারবার তলব করলেও পরিবহণ দফতর কেন বিভাগীয় তদন্তের ফাইল জমা দিতে পারছে না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
পরিবহণ দফতরের আইনজীবী নয়নচাঁদ বিহানি পাল্টা দাবি করেন, নিয়ম মেনেই উত্তমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তবে ফাইল হারানো নিয়ে কোনও স্পষ্ট ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত বিচারপতি উত্তমের পক্ষেই রায় দিয়েছেন।
বুধবার সন্ধ্যায় উত্তম বলছিলেন, “এতগুলো বছর ধরে আমাকে মিথ্যে অপবাদের বোঝা বয়ে বেড়াতে হল।” ঠিকই, তবে শেষ হাসিটা তিনিই হাসলেন। উত্তমকুমারের হাসি কি আর কেড়ে নেওয়া যায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy