প্রতীকী: সংখ্যায় বাড়ছে বাংলার বাঘ।
এত আলো, এত আঁধার আগে দেখিনি! ফেলে আসা বছরের দিকে তাকালে অনুভূতির সারাৎসার বোধহয় এটাই।
২০১৯ গর্ব করার মতো অনেক কিছু দিয়েছে। অমর্ত্য সেনের পরে অর্থনীতিবিদ আর এক বাঙালির নোবেল জয় যার অন্যতম। বিজ্ঞান সাধনায় বঙ্গসন্তানদের কৃতিত্ব অক্ষুণ্ণ। খেলা এবং বিনোদনের জগতেও বাঙালি পিছিয়ে নেই। এমনকি এই বছর আগ্রহের বিবিধ খোরাক মিলেছে রাজনীতিতেও।
কিন্তু বছর শেষে দেশ জুড়ে ঘনিয়ে আসা অন্ধকার প্রাপ্তির আলো অনেকখানি কেড়ে নিয়ে গেল। সেই ম্লানতা থেকে একা বাংলাই বা বাঁচবে কেমন করে! তাই পাওয়া, না-পাওয়ার হিসেব কষতে গেলে শেষ পাতায় যা পড়ে থাকে, তা হল একরাশ উদ্বেগ, শঙ্কা। বর্ষশেষের বাতাস অসূয়া ও অবিশ্বাসে ভারী।
তবু ভরসা এটুকুই, বাঙালি স্বধর্ম-চ্যুত হয়নি। জাতি-ধর্ম-বর্ণভেদ নস্যাৎ করে সকল বিভাজনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে রেখে বাংলা এবং বাঙালি পথে নেমেছে সবার আগে। প্রথমেই দেখা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পর পর অন্যেরাও। এর পিছনে রাজনীতি একেবারে নেই, তা নয়। তবে তার চেয়েও বেশি আছে দৃঢ় মানসিকতা। যুগ যুগ ধরে বঙ্গ চেতনায় যা সঞ্চারিত। এই শক্তি অনিঃশেষ।
অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও এস্থার দুফলো
অস্থির সময়ে বাঙালির জন্য আরও একটি প্রাসঙ্গিক সুখবর হল, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের বংশবৃদ্ধি। চলতি বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত বাঘ-শুমারির সর্বশেষ রিপোর্ট বলছে, গত চার বছরে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৭৫০। এখন সারা দেশে হাজার তিনেক রয়্যাল বেঙ্গলের বিচরণ। বাংলার বাঘ, বাংলার বাঘিনী এবং বাঘের বাচ্চা—সব মিলিয়ে বিষয়টি প্রতীকী বই কি!
বাস্তবে বাঙালির মনীষার সবচেয়ে উজ্জ্বল স্বীকৃতি এ বার বাংলার ছেলে, হার্ভার্ডের অধ্যাপক অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল প্রাপ্তি। তাঁর সঙ্গেই যুগ্ম প্রাপক তাঁর স্ত্রী এস্থার দুফলো। স্টকহলমে নোবেল পদক প্রদানের মঞ্চে ধুতি-পঞ্জাবি পরা অভিজিৎ এবং শাড়ি পরা ‘বঙ্গ-বধূ’ এস্থার আমাদের অহঙ্কার বাড়িয়ে দেন।
বিজ্ঞান সাধনায় দেশের সর্বোচ্চ সম্মান শান্তিস্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার প্রাপকদের মধ্যে এ বারেও বাঙালির আধিপত্য। পুরস্কৃত ১২ জনের মধ্যে ছ’জন বঙ্গসন্তান। এঁদের দু’জন, অনিন্দ্য সিংহ ও তাপসকুমার মাজি, বেঙ্গালুরুর জওহরলাল নেহরু সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্টিফিক রিসার্চ-এর বিজ্ঞানী। জীববিজ্ঞানী সৌমেন বসাকের কর্মক্ষেত্র ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইমিউনোলজি। শঙ্কর ঘোষ টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের গবেষক। সুবিমল ঘোষ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ান মুম্বইয়ের আইআইটি-তে। আর কলকাতায় ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের রাশিতত্ত্ব ও গণিত বিভাগে অধ্যাপনা করেন নীনা গুপ্ত। তাঁদের স্বীকৃতি বাঙালিকে গর্বিত করে। এগিয়ে চলার প্রেরণা দেয়।
রাজনীতি বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। সবাই মাঠে না নামলেও বেশির ভাগ বাঙালি রাজনীতি ভালবাসেন। সব কিছুতে রাজনীতি খুঁজে নেওয়ার অভ্যাসেও তাঁরা অনেকেই রপ্ত। তবে ইদানীং চর্বিতচর্বণের ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক চর্চা কিছুটা বৈচিত্র্যহীন হয়ে গিয়েছিল। ২০১৯ সেখানে ব্যতিক্রম।
বছরটি শুরুই হয়েছিল রাজনীতির গরম হাওয়ায়। সৌজন্য, লোকসভা ভোট। ‘বদলে দেওয়ার’ ঢাক বেজেছিল চড়াম চড়াম। আর তাতেও অগ্রণী ভূমিকা ছিল বঙ্গনেত্রী মমতার। বছরের শুরুতেই ব্রিগেডের মঞ্চে দেশের সব শীর্ষস্থানীয় বিজেপি-বিরোধী নেতাকে একজোট করে তিনি সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন সবার আগে।
কিন্তু সেই সব উদ্যোগের শোচনীয় পরিণতি শুধু দেশ নয়, বাংলার রাজনীতিকেও উথালপাথাল করে দেয়। রাজ্যে ১৮টি লোকসভা আসন দখল করে চমক দেখায় নরেন্দ্র মোদীর দল। শুরু হয় নতুন অঙ্ক কষা। তবে ছ’মাসের মধ্যেই বিধানসভার তিনটি উপনির্বাচনে বিজেপি-কে কোণঠাসা করে মমতার পাল্টা জবাব বর্ষশেষে ভিন্নতর আগ্রহ জিইয়ে রাখল। পাশাপাশি নয়া নাগরিকত্ব আইন এবং নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে আন্দোলন ঘিরে সূচনা হল এক নতুন পর্বের। ২০১৯-এর বিদায় বেলায় বঙ্গ রাজনীতি, অতএব, বেশ চনমনে!
রাজনীতির বঙ্গ-মঞ্চে দু’টি অন্য রকম মুখ এ বছর নজর কেড়েছে। এঁদের এক জন ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোর। অন্য জন রাজভবন নিবাসী জগদীপ ধনখড়। নিজেদের কাজের গণ্ডি ছাড়িয়ে তাঁরা দু’জনেই রাজনীতির মূল স্রোতে হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেছেন। এবং বিতর্কিতও।
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির কাছে ধাক্কা খাওয়ার পরে প্রশান্ত কিশোরকে পরামর্শদাতা করেছে তৃণমূল। এই রাজ্যে এমন পেশাদার ভোট-কুশলী নিয়োগের নজির আগে ছিল না। সেই পিকে ইতিমধ্যেই ‘স্বমহিমায়’ রাজ্যের শাসকদলের শিবিরে প্রতিষ্ঠিত এবং যথেষ্ট সমীহের সঙ্গে আলোচিত এক চরিত্র। তাঁর ‘নির্দেশ’ দলে বিশেষ মান্যতা পাচ্ছে।
বছরের মাঝামাঝি বাংলায় রাজ্যপাল হয়ে এসেই জগদীপ ধনখড় যে ভাবে ছড়ি ঘোরাতে নেমে পড়েছেন, তা-ও অভূতপূর্ব। সর্ব বিষয়ে সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের বিরোধের এমন তীব্র এবং তিক্ত প্রকাশ আগে কখনও দেখা যায়নি। নিয়মিত বিবৃতি দিয়ে, সাংবাদিক বৈঠক করে এই রাজ্যপাল নিজেকে কার্যত রাজনৈতিক নেতার স্তরে নিয়ে গিয়েছেন।
রাজভবনের এই ‘নয়া’ ভূমিকার পিছনে কি কোনও লুকোনো তাসের ‘খেলা’ আছে? ২০১৯ তা জানাতে পারেনি। বাংলার ‘দিদি’ জানলেও জানতে পারেন! বাকিটা অনুমান।
তবে খেলতে নামলে বাঙালি যে ‘লড়ে’ নিতে পারে, ভারতের ক্রিকেট প্রশাসনে সর্বোচ্চ পদ দখল করে ‘দাদা’ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বনাথ দত্তের পরে এই প্রথম একজন আদ্যন্ত বঙ্গসন্তান এই পদে বসলেন এই বছরেই। কলকাতার জগমোহন ডালমিয়াও বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তবু বাঙালি এ ক্ষেত্রে তার নিজস্ব জাত্যভিমান ছাড়তে রাজি নয়!
বিসিসিআই সভাপতি হয়েই সৌরভ তাঁর নিজের শহরে নিজের মাঠ ইডেনে গোলাপি বলে দিন-রাতের ক্রিকেট ম্যাচ সম্পন্ন করলেন। দেশে দিন-রাতের টেস্ট এই প্রথম। বাংলাদেশও এই প্রথম ইডেনে খেলল। আর বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে পাশে নিয়ে সেই খেলা দেখলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৯ সাক্ষী থাকল।
বাংলার অনূর্ধ্ব ২৩ ক্রিকেট দল ভারতসেরার সম্মান পেল এ বছর। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের বর্ষসেরা মহিলা ক্রিকেট দলে স্থান করে নিয়ে মান বাড়ালেন ঝুলন গোস্বামী। কৃতিত্বের তালিকায় উল্লেখ থাক কমনওয়েলথ গেমসে ভারোত্তোলনে সোনা-জয়ী রাখী হালদারের। সাউথ এশিয়ান গেমসে দশ মিটার এয়ার রাইফেল শুটিংয়ে সোনা জিতেছেন আর এক বঙ্গতনয়া মেহুলি ঘোষ। কমনওয়েলথে টেবলটেনিস সিঙ্গলসে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ঐহিকা মুখোপাধ্যায়। ডবল্সে কৃত্তিকা সিংহরায়।
বছর ফুরোনোর বেলায় টেনিস-তারকা লিয়েন্ডার পেজ জানালেন, তিনি এ বার পেশাদার টেনিস থেকে অবসর নেবেন। তাঁর খেলার জীবন শুরু হয়েছিল কলকাতায়। বাঙালি তাঁকেও ‘ঘরের লোক’ মনে করে।
বাংলার সাহিত্যে নতুন কোনও উদ্ভাস এই বছরেও নেই। সিনেমার জগতে জাতীয় পুরস্কারকে মানদণ্ড ধরলে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘এক যে ছিল রাজা’র উল্লেখ অনিবার্য। সুরের জগত থেকে চিত্রপরিচালনায় পা দিয়েই ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত তাঁর প্রথম ছবি ‘কেদারা’র জন্য পেয়েছেন বিশেষ জুরি পুরস্কার। ‘তারিখ’ ছবিতে শ্রেষ্ঠ সংলাপের জাতীয় পুরস্কার জিতে নিয়েছেন পরিচালক চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায়। বিতর্কের জেরে হল ভরিয়েছে ‘গুমনামি’। বক্স অফিস গরম রেখেছিল ‘কণ্ঠ’, ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন’ এবং ‘মিতিন মাসি’। প্রাপ্তির খাতায় এগুলিও লেখা থাক।
তবে ফেলে আসা বছরে বাংলায় বিদায়ের পাল্লাও বেশ ভারী। সাহিত্য, শিল্প এবং কলাক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে স্মরণীয়দের মধ্যে আছেন নবনীতা দেবসেন, রুমা গুহঠাকুরতা, চিন্ময় রায়, দিব্যেন্দু পালিত, অদ্রীশ বর্ধন, ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী, রবীন মণ্ডল, অমর পাল, স্বরূপ দত্ত, নিমু ভৌমিক ও প্রতীক চৌধুরী। দুই প্রবীণ বাম-নেতা সিপিআই-এর গুরুদাস দাশগুপ্ত, আরএসপি-র ক্ষিতি গোস্বামী এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের ‘বড়মা’ বীণাপাণি দেবীর জীবনাবসান হয়েছে এই বছরেই। প্রয়াত হয়েছেন কলকাতার দুই প্রবীণ ও স্বনামখ্যাত
শিল্পপতি বসন্তকুমার বিড়লা এবং ব্রিজমোহন খেতান।
প্রয়াণের বেদনা এ ভাবেই প্রতিটি বছরকে ভারাক্রান্ত করে। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। বরং পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নূতনকে স্বাগত জানানোর চলমানতায় তার উত্তরণ।
এই বিশ্বাস আঁকড়ে ধরেই নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে হবে। আর ২০১৯ থেকে ২০২০-তে পা দেওয়ার মুহূর্তে শপথ নিতে হবে, উনিশ-বিশে ফারাক আগামী দিনে যেন স্পষ্ট হয়। ‘উনিশ’-এর আঁধার ঘুচিয়ে ‘বিশ’ যেন আলোকিত হয়ে ওঠে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy