Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
বছর ঘোরে, কেউ কথা রাখে না। বন্ধ বাগানে ছোটদের থালায় ডালটুকুও বিলাসিতা
Financial Struggle

খিদের মুখে পাতে শুধু চা-ফুল ভাজা

রোজ রান্নার জন্য যে ডাল দরকার, তা কেনার ক্ষমতা নেই। সপ্তাহে একদিন একবেলা ডিম হয়। মাসের গোড়ায় এক দিন মাংস। সামনের মাসে তা-ও হবে না।

An image of Tea Garden

দুপুরের রান্নার জন্য চায়ের ফুল বাছছেন এক মহিলা শ্রমিক। জলপাইগুড়ির রায়পুর চা বাগানে। ছবি: সন্দীপ পাল।

অনির্বাণ রায় , সৌম্যদ্বীপ সেন
জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ার শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২৪ ০৯:২০
Share: Save:

শীত-সকালের একফালি রোদ এসে পড়েছে তাঁর জবুথবু পিঠে। তিনি তখন একটা একটা করে চা-ফুল তুলে রাখছেন স্টিলের ফুটো থালায়। পা ফুলে গিয়েছে অনেক দিন আগে। বাগানে আসা মেডিক্যাল টিমের কাছে ওই রোগের চিকিৎসা নেই। ইদানীং এ সব নিয়ে কথা বলেন না মনা মুন্ডা। দিনভর মুখে বিশেষ সাড়া নেই। মেয়ে রেণুকা মুন্ডা বললেন, “শীত থাকা পর্যন্ত চা-ফুল পাওয়া যাবে। পেঁয়াজ, লঙ্কা দিয়ে তেলে ভেজে নেব। ভাজা ফুলের গায়ে লেগে থাকা পেঁয়াজ আর তেল দিয়ে ভাত মাখা যায়।”

রোজ রান্নার জন্য যে ডাল দরকার, তা কেনার ক্ষমতা নেই। সপ্তাহে একদিন একবেলা ডিম হয়। মাসের গোড়ায় এক দিন মাংস। সামনের মাসে তা-ও হবে না। কারণ, বাগানে এখন পাতা তোলা বন্ধ। চা-ফুল ভাজা দিয়ে বড়রা দু’বেলা ভাত খান। ছোটরা তিন বেলা। রেণুকা বলেন, “চাল কিনতেই অনেক টাকা চলে যায়। তাই ঝোল রান্নার মশলাও সব দিন থাকে না।”

সরকারি রেশনে বিনা পয়সায় চাল দেওয়ার কথা। রেণুকার অভিজ্ঞতা, “রেশনে মাসে ২২ কেজি চাল পাই। কিন্তু সেই চাল খেলে পেট খারাপ হয়। সে আর এক হয়রানি। রেশনের চাল তাই বাজারে ২০ টাকা কেজিতে বিক্রি করে দিই। ভাত খাবার চাল বাজার থেকে কিনতে ৩০ টাকা লাগে।” ছেলে-মেয়ে, মা-বোন মিলে রেণুকার বাড়িতে আট জন। ঠিকঠাক পেট ভরাতে মাসে চাল লাগে অন্তত ৪০ কেজি। অন্তত হাজার দেড়েক টাকা চাল কিনতেই চলে যায়। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর টাকাতেও চাল কেনা কুলোয় না। মায়ের হাতে ধরা থালা থেকে চা-ফুল নিয়ে কড়াইয়ে ফেলে রেণুকা বলেন, “বড়রা তিন বেলা ভাত খেতে পারি না ছেলেমেয়েগুলো কাঁদে বলে ওদের তিন বেলা ভাত দিতে হয়।”

জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া বন্ধ রায়পুর চা বাগানে শীতের বেলা গড়াতে থাকে। গাছগাছালির ছায়া দীর্ঘতর হয়।

বছর দু’য়েক ধরে বাগান পুরোপুরি বন্ধ। শ্রমিকেরা নিজেরা পাতা তুলে বাজারে বিক্রি করেন। যে দিন কাজ থাকে, সে দিন দেড়শো টাকা মতো ভাগে পান শ্রমিকেরা। এখন পাতা তোলা বন্ধ। হাতে সেটুকুও নেই। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর টাকায় নুন-ভাত হয় কোনও বাড়িতে, কেউ কেউ মটরশুঁটি, আলু কুড়োতে পাশের গ্রামে যান। তাতেও যে দিন কাজ, সে দিন মজুরি জোটে শ’দুয়েক টাকা।

কাজের খোঁজ করতে আশপাশের গ্রামে প্রতিদিনই যান দেবী খরিয়ার মা। বোনাসের কথাবার্তা চলার মুখে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দলসিং পাড়া চা বাগান। পুজো, দীপাবলি, বড়দিন চলে গেল। এসে পড়ল নতুন বছর। দেবী খরিয়ার মা পাশের গ্রামে কাজ খুঁজতে যাওয়াকে রোজকার অভ্যেস বানিয়ে নিলেন। কিন্তু কাজ রোজ মেলে না। দেবী খরিয়া বলেন, “বাবা কাজ করতে বাইরের রাজ্যে গিয়েছেন। প্রতি মাসে টাকা পাঠান না। মা সপ্তাহে এক-দু’দিন কাজ পান। সকালে বেরিয়ে যে দিন মা বেলা-বেলা ফিরে আসেন, বুঝি কাজ পাননি।’’ তার পরে একটু অন্যমনস্ক ভাবেই বলেন, ‘‘মাকে এক ঘটি জল এগিয়ে দিয়ে ঝোপ থেকে কচুপাতা তুলে এনে হাঁড়িতে চালের সঙ্গে ছেড়ে দিই।”

পুজোর আগে থেকে বন্ধ আলিপুরদুয়ারের রায়মাটাং চা বাগানের শ্রমিক ধনিরাম ভুজেল সপ্তাহ খানেক আগে তামিলনাড়ু চলে গিয়েছেন কাজের খোঁজে। তিনি বলছিলেন, “বাগান কবে খুলবে কে জানে! শেষের দিকে বাড়িতে ছেলে-মেয়েকেও পেট ভরে খেতে দিতে পারছিলাম না। তাই এত দূরে কাজে আসতে বাধ্য হলাম।”এমনই এক বন্ধ চা বাগান আলিপুরদুয়ারের ঢেকলাপাড়া। সেই বাগানের শ্রমিক সুশীল ওরাওঁয়ের গাড়ি ডাকার মতো টাকা ছিল না। অসুস্থ অবস্থায় কার্যত বাড়িতে পড়ে থেকে মৃত্যু হল তাঁর। তাঁর দাদা বলছিলেন, ‘‘দু’মাস ধরে বাগানে কাজ বন্ধ। মজুরি নেই। টাকা পাবেকোথায়!’’

(চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

Tea Garden Jalpaiguri Tea Garden Labourers
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy