(বাঁ দিকে) নীচে জয়া চট্টোপাধ্যায়, উপরে প্রীতম ভদ্র। মাঝখানে চন্দ্রশেখর ঘোষ এবং নীচে দেবলীনা সরকার, উপরে অরণি মুখোপাধ্যায় (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
বেড়া ভেঙে নতুন ঐতিহ্য স্থাপনের পথেই বরাবর হেঁটে এসেছে আনন্দবাজার অনলাইন। সেই পথচলার দৃপ্তভঙ্গিতে গাঁথা রয়েছে তার শ্রেষ্ঠত্বের অন্বেষণও। ভৌগোলিক থেকে সামাজিক বেড়া ভাঙার সাহসে আলোকিত হয়ে রইল আনন্দবাজার অনলাইনের ‘বছরের বেস্ট' সন্ধ্যা। অতিমারি আবহে সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠান দিয়ে যে যাত্রার সূত্রপাত, তা এ বছর চারে পা দিল! আড়ে-বহরে চোখ টেনে সপ্তাহ শুরুর ঝলমলে সন্ধ্যায় আইটিসি সোনারে ‘বছরের বেস্ট’ শিরোপা পেলেন ১০ জন। গত ১২ মাসের এই ১০ কৃতী বাঙালিকে খুঁজে নিয়েছে আনন্দবাজার অনলাইন। সেই মঞ্চেই মিলে গেল বাংলার ইতিহাস থেকে বাঙালির ব্যবসার কাহিনি। একত্র হলেন বাঙালি চিত্রশিল্পী, বিজ্ঞানী, রন্ধনশিল্পী এবং অভিনেত্রী।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই সঙ্গীতশিল্পী অনুপম রায়ের উদাত্ত কণ্ঠে ‘উপনিষদের গানে’ বাঁধা হয়ে গিয়েছিল অনুষ্ঠানের মূল সুর। তা হল ধারাবাহিকতা আর পরিবর্তনের দ্বন্দ্ব। তা-ই আরও বিশদে শোনা গেল অভীক সরকারের বক্তব্যে। পরিবর্তনের কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, সিঙ্গুর আন্দোলনের পর বাঙালি জীবনে যে আন্দোলনবিমুখতা দেখা গিয়েছিল, তা আবার স্ফুলিঙ্গের মতো ফিরে এসেছে আরজি কর-কাণ্ডের আবহে। আর ধারাবাহিকতা? অভীকবাবু অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন বাঙালির ব্যবসাবিমুখতার দিকে।
বাংলায় কবি পাওয়া যায়। চিত্র পরিচালক পাওয়া যায়। পাওয়া যায় আন্দোলনকারীও। কিন্তু বাঙালি ব্যবসায়ী সেই অর্থে মেলে না! বাঙালির পূর্বপুরুষেরা হলেন ধনী বণিক চাঁদ সওদাগর বা জগত শেঠ, আর সেই জাতির রক্তেই কি না ব্যবসা নেই? সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি বদলেছে। তবে বদল সেই ভাবে যে চোখে পড়ার মতো নয়, তা বলাইবাহুল্য। তবে কেউ কেউ প্রথাগত ধারণার বাইরে গিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, বাঙালিকে ব্যবসামুখী করারও আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের এক জন উদ্যোগপতি চন্দ্রশেখর ঘোষকে শুধু এ বছরের নয়, ‘দশকের বেস্ট’ হিসাবে বেছে নিয়েছে আনন্দবাজার অনলাইন। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম।
বাংলার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী সঞ্জীব গোয়েন্কা এবং রবি মোদীর মতোই বড় পরিসরে কারবার চন্দ্রশেখরের। গত ১০ বছরে ক্রমাগত বেড়েছে তাঁর বিষয়আশয়। তার নিরিখেই ‘দশকের বেস্ট’ চন্দ্রশেখর। সঞ্চালক অনিন্দ্য জানা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘আপনি কখনও কবিতা লিখেছেন?’’ জবাব এসেছিল, ‘‘না।’’ চন্দ্রশেখরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘‘কখনও ছাত্র আন্দোলন করেছেন?’’ জবাব ছিল, ‘‘না।’’ এ সব না করলেও বাঙালিকে ব্যবসামুখী করার কথা অবশ্যই ভেবেছেন চন্দ্রশেখর। তিনি বলেন, ‘‘বাঙালিকে ব্যবসামুখী করব বলেই তো ব্যাঙ্কিং পরিসরে এসেছি। ব্যাঙ্কিং পরিষেবা কতটা সহজ ভাবে মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে, তার উপরেই সব নির্ভর করে। সেটার জন্যই আমার প্রথম কাজ হল মাইক্রো ক্রেডিট। তা হল— সাধারণ মানুষের কাছে কী ভাবে নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়া যায়। যখনই তা হবে, তখনই মানুষের মাথায় ব্যবসার চিন্তা আসবে।’’ শুধু চন্দ্রশেখরই নন, ‘বছরের বেস্ট’ হিসাবে ব্যবসায়ী রাধেশ্যাম আগরওয়াল এবং রাধেশ্যাম গোয়েন্কাকেও পুরস্কৃত করেছে আনন্দবাজার অনলাইন। রাধেশ্যাম আগরওয়াল অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে পারেননি। ছিলেন তাঁর পুত্র আদিত্য আগরওয়াল। তবে রাধেশ্যাম গোয়েন্কা ছিলেন। তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন শিল্পপতি হর্ষবর্ধন নেওটিয়া এবং রাজ্যের মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়।
শুধু ব্যবসা বিমুখতাই নয়, বাঙালির ‘ইতিহাস-বিস্মৃতি’ নিয়েও অনেকে কটাক্ষ ছুড়ে থাকেন। বলা হয়, বাঙালি নাকি ইতিহাস মনে রাখে না! সেই ক্ষেত্রের এক কৃতীও এ বার ‘বছরের বেস্ট’ শিরোপা পেলেন। তিনি হলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জয়া চট্টোপাধ্যায়। জয়া থাকেন সুদূর ব্রিটেনে। তাঁর শরীরও খুব একটা ভাল নয়। হুইলচেয়ারে বন্দি তিনি। তা সত্ত্বেও তিনি অনুরোধে সাড়া দিয়েছেন। যোগ দিয়েছেন অনুষ্ঠানে। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়।
খুব কম পণ্ডিতই গভীর কথাকে সহজ করে তুলে ধরার দুঃসাহস দেখাতে পারেন। জয়া সেই কাজটিই করে চলেছেন। আজকের ইতিহাসবিদেরা সাধারণত খণ্ডচিত্র তুলে ধরার পক্ষপাতী। এখন আর আগের মতো মঙ্গলকাব্য বা রামায়ণের মতো মহাকাব্য লেখার চল নেই। কিন্তু জয়ার সদ্যপ্রকাশিত বই ‘শ্যাডোজ় অ্যাট নুন’ সেই সাবেক ধারাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। তার সঙ্গে মিশেছে আধুনিক রীতিতে ব্যক্তিগত জীবনের গল্প। আর গোটা উপমহাদেশের কাহিনি। সেটা তিনি বলতে পেরেছেন প্রায় গড়গড় করে। জয়ার বইয়ে স্থান পেয়েছে বাংলাভাগের কাহিনিও। আনন্দবাজার অনলাইনের থেকে পুরস্কার পেয়ে তিনি বলেন, ‘‘ভীষণই অদ্ভুত লাগছে!’’ কথায় কথায় তিনি জানান, বাঙালি পাঠকদের কাছে আনন্দবাজারের গুরুত্ব ঠিক কতটা। তিনি নিজেও যে তা নজরে রাখেন নিয়মিত, তা-ও বার বার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন জয়া।
আনন্দবাজার অনলাইনের ‘বছরের বেস্ট’ পুরস্কার পেয়েছেন বাঙালি গবেষক দেবলীনা সরকার। সঞ্চালক অনিন্দ্য জানার কথায়, তিনি ‘মহিলা প্রফেসর শঙ্কু’, যিনি অনায়াসেই সত্যজিৎ রায়ের গল্পের প্রধান চরিত্র হয়ে উঠতে পারেন। দুনিয়ার সবচেয়ে পাতলা ‘চিপ’ তৈরি করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন দেবলীনা। বিজ্ঞানের জগতে নারীর সংখ্যা এখনও অপ্রতুল। সেই অর্থেও তাঁর অধ্যয়নজনিত কৃতিত্ব ব্যক্তিগত গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহত্তর সমাজজীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। যা অনুপ্রাণিত করেছে বিশ্বজোড়া বাঙালি সমাজকে।
দেবলীনার হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ও অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য মালবিকা সরকার। সঞ্চালক দেবলীনাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আবিষ্কার কি কোনও অনুপ্রেরণা থেকে আসে? না কি এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ফল? জবাবে দেবলীনা বলেন, “দুটোই। আমার বাড়িতে এক জন প্রফেসর শঙ্কু আছেন। আমার বাবা। ছোটবেলা থেকে দেখেছি বাবা নিজে বিভিন্ন গবেষণার কাজ করতেন। উনি এমন একটা ওয়াশিং মেশিন বানিয়েছিলেন যা বিদ্যুৎ ছাড়া চলে। এমন একটি পুলি বানিয়েছিলেন যা দিয়ে ভারী জিনিস সহজেই ছাদে তোলা যায়। সেগুলো দেখেই আমি প্রথম অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম।”
সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বছরভর সাফল্যে যাঁরা নজর কেড়ে থাকেন, প্রতি বছর ‘বছরের বেস্ট’ অনুষ্ঠানে তাঁদেরই পুরস্কৃত করে আনন্দবাজার অনলাইন। তাঁদের কেউ তারকা। কেউ খ্যাতনামী। কেউ শিক্ষা, কেউ প্রযুক্তিতে, কেউ বিজ্ঞান, কেউ বিনোদনে তাক লাগিয়েছেন। তাঁদের ভিড়ে জায়গা করে নিয়েছেন সাধারণ হয়েও ‘অ-সাধারণ’ এক মানুষ। গ্ল্যামারের দ্যুতি থেকে ঢের দূরে থেকেও তিনি ‘বছরের বেস্ট’। পেশায় আইনের রক্ষক। অকুতোভয় এবং ব্যতিক্রমী পেশাদারও বটে। মালদহের স্কুলের ক্লাসরুমে এক বন্দুকবাজের সামনে নিরস্ত্র হয়েও তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কর্তব্যের তাগিদে। সেই অসমসাহসিক কাজের জন্য প্রাণ বেঁচেছিল ৭১ জন পড়ুয়ার। তিনি যেমন পুলিশ বাহিনীর কাছে কর্তব্যপরায়ণতার নজির স্থাপন করেছেন, তেমনই পুলিশের প্রতি এক অর্থে নতুন করে ভরসাও দিয়েছেন সমসময়ের বাংলাকে। তিনি হলেন পুলিশ অফিসার আজহারউদ্দিন খান। তাঁকে পুরস্কৃত করেছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু।
খাদ্য এবং রসনাশিল্পের জগতে অসামান্য অবদানের জন্য আনন্দবাজার অনলাইন ‘বছরের বেস্ট’ সম্মানে ভূষিত করেছে রন্ধনশিল্পী অরণি মুখোপাধ্যায় এবং প্রীতম ভদ্রকে। তাঁদের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী। চিত্রকলার জগতে ব্যতিক্রমী অবদানের জন্য পুরস্কৃত হয়েছেন চিত্রশিল্পী শ্রেয়সী চট্টোপাধ্যায়। তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন সঙ্গীতশিল্পী রূপম ইসলাম এবং চিত্র পরিচালক সুজিত সরকার। বছরের সেরা অভিনেত্রী হিসাবে পুরস্কৃত হয়েছেন বাংলা ধারাবাহিক ‘মিঠাই’ খ্যাত সৌমীতৃষা কুন্ডু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy