অনুপ মাজি। —ফাইল চিত্র
তাঁর খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরেছে সিবিআই, এমনকি ইডিও। কয়লা পাচার মামলায় সেই অধরা মূল অভিযুক্ত অনুপ মাজি ওরফে লালা নিজেই ধরা দিলেন। মঙ্গলবার সকালে আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। শর্তসাপেক্ষে তাঁকে জামিন দেয় আদালত।
কিন্তু কে এই অনুপ মাজি, যিনি লালা নামেই সমধিক পরিচিত? ২০২০ সালে কয়লা পাচার মামলার তদন্ত শুরু করে সিবিআই। রাজ্যে রেলের বিভিন্ন সাইডিং এলাকা থেকে কয়লা চুরির ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই প্রথমে আয়কর দফতর, তার পরে সিবিআই কয়লাকাণ্ডের তদন্তে নামে। তদন্তে উঠে আসে লালার নাম। খাদান থেকে বেআইনি ভাবে কয়লা তুলে পাচারের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এই কাজে তাঁকে সাহায্য করার অভিযোগ ওঠে ইসিএল, নিরাপত্তা সংস্থা সিআইএসএফ, রেলের এক শ্রেণির কর্মীদের বিরুদ্ধে। আরও অভিযোগ ওঠে যে, কয়লা পাচারের টাকা ঘুরপথে তাঁদের কাছে পৌঁছে দিতেন লালা। পাচারের সঙ্গে নাম জড়িয়ে যায় তৃণমূলের তৎকালীন যুব নেতা বিনয় মিশ্র এবং তাঁর ভাই বিকাশের। বিকাশকে ইডির হাতে গ্রেফতারও হন।
অন্য দিকে ‘পলাতক’ লালা আত্মগোপন করে থাকা অবস্থায় সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। তাঁর আবেদনের প্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দেয়, লালার বিরুদ্ধে এখনই কোনও কড়া পদক্ষেপ করা যাবে না। ২০২১ সালের মার্চে এই ‘রক্ষাকবচ’কে হাতিয়ার করেই নিজাম প্যালেসে সিবিআই দফতরে হাজিরা দিয়েছিলেন লালা। তাঁকে প্রায় সাত ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার পরেও অবশ্য লালার বাড়ি, অফিসে তল্লাশি, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত শুরু হয়। লালার সঙ্গী বলে পরিচিত গুরুপদ মাজি-সহ চার জন গ্রেফতার হন। পরে এই মামলায় তদন্ত শুরু করে আর এক কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি।
লালা অবশ্য প্রথমে কলকাতা হাইকোর্টে গিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, রাজ্যের অনুমতি ছাড়া সিবিআই এই তদন্ত শুরু করেছে। সিবিআইকে রাজ্যে কোনও মামলার তদন্ত করতে দেওয়ার ‘সাধারণ সম্মতি’ ২০১৮ সালে প্রত্যাহার করে নিয়েছে নবান্ন। হাইকোর্টে প্রথমে রায় দিয়েছিল, রেলের জায়গার বাইরে সিবিআইকে কোনও তল্লাশি করতে হলে রাজ্যের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু পরে ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেয়, রাজ্যের সর্বত্রই সিবিআই কয়লা পাচারের তদন্ত করতে পারবে। এই রায়ের বিরুদ্ধেই সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন লালা।
এর আগে সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছিল, লালার সঙ্গে গরু পাচারে অভিযুক্ত এনামুল হকেরও বোঝাপড়া ছিল। কয়লা পাচারের সময় এনামুলের ‘সিন্ডিকেট’-এর সাহায্য নিতেন লালা। উত্তরবঙ্গ-সহ প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতেও পাচার চলত। রাজনৈতিক মদতের পাশাপাশি লালার সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসন, ইস্টার্ন কোল্ডফিল্ড, রেলকর্তাদের একাংশেরও যোগাযোগ রয়েছে বলে দাবি করে সিবিআই। তদন্তে লালার একটি ডায়েরি উদ্ধার করেছিলেন ইডির তদন্তকারীরা। ইডি সূত্রে জানা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কয়লা পাচারে রাজ্য পুলিশের বড় কর্তাদের একাংশ যে যুক্ত ছিলেন, তার ‘প্রমাণ’ রয়েছে ওই ডায়েরিতে।
কিন্তু কয়লা পাচার মামলায় চার্জ গঠন করে তদন্ত শেষ করার জন্য কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাকে নির্দেশ দেন আসানসোলের বিশেষ সিবিআই আদালতের বিচারক রাজেশ চক্রবর্তী। আগামী ২১ মে এই মামলায় চার্জশিট পেশ করার কথা সিবিআইয়ের। কিন্তু আদালতে সিবিআই প্রশ্ন তোলে যে, লালাকে জিজ্ঞাসাবাদ না করা হলে কী ভাবে কয়লা পাচার মামলায় চূড়ান্ত চার্জ গঠন করা সম্ভব? বিচারক সিবিআইয়ের উদ্দেশে জানান, লালা গ্রেফতারির ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ পেলেও তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদে কোনও বাধা নেই। আদালতের জিজ্ঞাসাবাদ সংক্রান্ত নির্দেশ পাওয়ার পরেই লালার খোঁজে অভিযান শুরু করে সিবিআই। যদিও লালার বাড়ি গিয়ে তাঁর খোঁজ পাননি তদন্তকারীরা।
এই আবহে কয়লা পাচার মামলায় মূল অভিযুক্ত লালা মঙ্গলবার সকালে আসানসোলের বিশেষ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। শর্তসাপেক্ষে তাঁকে জামিন দেওয়া হয়। জামিনের শর্ত হিসাবে আদালত জানিয়েছে, লালাকে তদন্তে সহযোগিতা করতে হবে। নিম্ন আদালতের নির্দেশ মোতাবেক, আগামী সোমবার (২১ মে) কয়লা পাচার মামলায় চূড়ান্ত চার্জ গঠন করতে হবে সিবিআইকে। তার পরই এই মামলায় বিচারপ্রক্রিয়া বা ট্রায়াল শুরু হওয়ার কথা। বিশেষ আদালতের নির্দেশ, মামলার শুনানির দিনগুলিতে সশরীরে কোর্টে হাজিরা দিতে হবে লালাকে। লালাকে পৈতৃক বাড়িতে থাকারও নির্দেশ দিয়েছে আদালত। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর মহকুমার নিতুড়িয়া থানা এলাকার অন্তর্গত ভামোরিয়া গ্রামে লালার পৈতৃক বাড়ি। সেখানেই থাকেন তাঁর মা। এখন তাঁকে ওই ঠিকানাতেই থাকার নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। আদালতের অনুমতি ছাড়া এলাকা ছাড়তে পারবেন না লালা।
সাম্প্রতিক কালে গরু এবং কয়লা পাচার মামলা বার বার শিরোনামে এসেছে। এর সঙ্গে নাম জড়িয়েছে রাজনীতিকদের। কয়লা পাচারকাণ্ডে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী অভিযোগ তুলেছিলেন যে, কয়লা পাচারকাণ্ডে অভিযুক্ত লালাই অভিষেকের স্ত্রীর বিদেশি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নিয়মিত টাকা জমা করতেন। লালার সূত্রে কয়লা পাচার মামলায় নাম উঠে আসে রাজ্যের মন্ত্রী মলয় ঘটকেরও। তবে চার্জশিটে তাঁর নাম ছিল না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy