Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
নিয়োগ বন্ধের আশঙ্কা

সপ্তাহে পড়ানোর সময় বাড়ছে আট ঘণ্টা

ছাত্রছাত্রীদের হাতে তাঁদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা নিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বড় অংশের আপত্তি বা ক্ষোভ তো রয়েছেই। তারই মধ্যে শিক্ষকদের ক্লাস নেওয়ার সময় বাড়ানো হচ্ছে বলে সংশোধিত নতুন নিয়মে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সপ্তাহে পড়ানোর সময় বাড়তে পারে আট ঘণ্টা পর্যন্ত।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৬ ০৩:৪২
Share: Save:

ছাত্রছাত্রীদের হাতে তাঁদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা নিয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বড় অংশের আপত্তি বা ক্ষোভ তো রয়েছেই। তারই মধ্যে শিক্ষকদের ক্লাস নেওয়ার সময় বাড়ানো হচ্ছে বলে সংশোধিত নতুন নিয়মে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সপ্তাহে পড়ানোর সময় বাড়তে পারে আট ঘণ্টা পর্যন্ত।

শিক্ষা শিবিরের একটি অংশের মতে, শিক্ষার মান উন্নয়নের স্বার্থে বাড়তি সময় পড়ানোর ব্যবস্থা করা যেতেই পারে। কিন্তু অন্য অংশের বক্তব্য, এই বন্দোবস্ত আসলে নতুন শিক্ষক নিয়োগের রাস্তা প্রায় বন্ধ করে দেওয়ারই ইঙ্গিত। আর তাতে সব থেকে বড় বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন অতিথি ও আংশিক সময়ের শিক্ষক এবং চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারা। কারণ, স্থায়ী শিক্ষকদের কাজের সময় বাড়ালে তাঁদের ক্লাসে কোপ পড়তে পারে। ওই শিক্ষকদের দাবি, তাঁরা স্থায়ী চাকরির আশাতেই দীর্ঘদিন ধরে অল্প পারিশ্রমিকে খেটে চলেছেন। স্থায়ী নিয়োগের পথ বন্ধ হলে তাঁদের ভবিষ্যৎই তো অন্ধকার হয়ে যাবে। কী করবেন তাঁরা?

সরাসরি জবাব দেওয়ার কেউ নেই। তবে শিক্ষক সংগঠনগুলির বক্তব্য, এই নতুন নিয়মে শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতি যে আটকে যাবে, তাতে প্রায় কোনও সন্দেহই নেই।

কী বলছে ইউজিসি-র নয়া নিয়ম?

চলতি মাসে প্রকাশিত নতুন নির্দেশিকার তৃতীয় সংশোধনীতে ইউজিসি জানিয়েছে, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরদের এ বার সপ্তাহে মোট ২৪ ঘণ্টা ক্লাস নিতে হবে। ২০১০ সালের নিয়মে এই সময়সীমা ছিল সপ্তাহে ১৬ ঘণ্টা। একই ভাবে অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরদের ক্লাস নিতে হবে সপ্তাহে ২২ ঘণ্টা। আগের নিয়মে যা ছিল ১৪ ঘণ্টা। অর্থাৎ দুই শ্রেণির শিক্ষকের ক্ষেত্রেই ক্লাস নেওয়ার সময় বাড়ছে সপ্তাহে আট ঘণ্টা। ল্যাবরেটরি বা প্রজেক্টের কাজে অতিবাহিত দু’ঘণ্টাকে ধরা হবে এক ঘণ্টা ক্লাস লেকচারের সমান। যে-সব শিক্ষকের অধীনে পাঁচ জন বা তার বেশি পিএইচডি পড়ুয়া রয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে নির্ধারিত সাপ্তাহিক ক্লাসের সময় থেকে দু’ঘণ্টা ছুটি মিলবে।

নতুন নিয়মে শিক্ষকদের উপরে যে-অতিরিক্ত ভার চাপানো হচ্ছে, দিল্লির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংগঠন ইতিমধ্যেই তার প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিবাদপত্র জমা পড়েছে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের কাছেও। ইউজিসি-র একটি সূত্র জানাচ্ছে, শিক্ষকদের ক্লাসের সময় সংক্রান্ত নতুন নিয়ম নিয়ে আপত্তি জানিয়ে বৃহস্পতিবারেই মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের তরফে ইউজিসি-র কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। সারা দেশ থেকে শিক্ষকদের কী প্রতিক্রিয়া আসে, তার জন্য অপেক্ষা করছে ইউজিসি। সব মতামত জানার পরে নতুন নিয়মের কোনও অংশে কোনও রকম সংশোধনী প্রয়োজন কি না, তা খতিয়ে দেখবে তারা।

শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ক্লাসের সময় বাড়ানোর ব্যাপারে ইউজিসি-র নতুন নির্দেশিকা নিয়ে এ রাজ্যের কলেজ প্রশাসকদের অনেকেই উদ্বিগ্ন। কলকাতার দু’টি কলেজের অধ্যক্ষ জানাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ কলেজেই পঠনপাঠন প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে অতিথি শিক্ষক, আংশিক সময়ের শিক্ষক বা চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত শিক্ষকদের উপরে। স্থায়ী পদে নিয়োগ আটকে থাকায় ওই শিক্ষকদের উপরেই নির্ভর করতে হয় ছাত্রছাত্রীদের। এই অবস্থায় স্থায়ী শিক্ষকদের পড়ানোর সময়সীমা বাড়ানোর একটাই অর্থ। ইউজিসি চায়, নির্দিষ্ট ক্লাসগুলি তাঁদের দিয়েই করানো হোক। অর্থাৎ অতিথি, আংশিক সময় বা চুক্তির শিক্ষকদের আর রাখতে চাইছে না ইউজিসি।

এই মুহূর্তে রাজ্যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে অতিথি শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। আংশিক সময়ের শিক্ষক রয়েছেন অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার। আর চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকের সংখ্যা কমবেশি সাড়ে পাঁচশো। ক্লাস নেওয়া থেকে শুরু করে খাতা দেখা, পরীক্ষায় নজরদারি— সব কিছুর জন্যই নির্ভর করতে হয় ওই শিক্ষকদের উপরে। ইউজিসি-র নতুন নির্দেশিকা কার্যকর হলে ওই তিন ধরনের শিক্ষকের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যেতে পারে বলে শিক্ষক সংগঠনগুলির আশঙ্কা।

রাজ্যের অতিথি শিক্ষক সমিতির সম্পাদক গোপালচন্দ্র ঘো ষ বলেন, ‘‘স্থায়ী শিক্ষকদের ক্লাস বাড়ালে আমাদের ক্লাসেই তো টান পড়বে। সে-ক্ষেত্রে আমাদের স্থায়ী নিয়োগের কোনও সম্ভাবনাই থাকবে না। নতুন শিক্ষামন্ত্রী দায়িত্ব নিলে বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রে দরবার করার জন্য আমরা তাঁর কাছে আবেদন করব।’’ দরবার হোক না-হোক, কলেজ অ্যান্ড ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েসন অব বেঙ্গল (কুটাব)-এর সাধারণ সম্পাদক গৌরাঙ্গ দেবনাথ কেন্দ্রীয় সরকারের উপরেও আস্থা রাখতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘‘কেন্দ্র হোক বা রাজ্য, নতুন কোনও নিয়োগের চিন্তা করছে না কেউই। পূর্ণ সময়ের শিক্ষকদের থেকে অতিথি ও আংশিক সময়ের শিক্ষকেরা অনেক বেশি দায়িত্ব পালন করেন। অথচ তাঁদের নিয়োগের সম্ভাবনা সঙ্কুচিত করে আনা হচ্ছে।’’

গৌরাঙ্গবাবু জানান, এই মুহূর্তে রাজ্যের কলেজগুলিতে ২৯ হাজারেরও বেশি পূর্ণ সময়ের শিক্ষকপদ খালি। সেই ঘাটতি সামাল দিচ্ছেন অতিথি ও আংশিক সময়ের শিক্ষক এবং চুক্তি-শিক্ষকেরাই। পূর্ণ সময়ের পদ পূরণের ব্যবস্থা হলে ওই শিক্ষকদের স্থায়ী চাকরি হতে পারে। সেই সঙ্গে নতুন প্রার্থীরাও
কাজ পেতে পারেন। তা না-করে পূর্ণ সময়ের শিক্ষকদের কাজের সময় বাড়িয়ে অন্য প্রার্থীদের পথ বন্ধ করার ব্যবস্থা কেন, প্রশ্ন তুলছে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন।

শিক্ষাবিদদেরও অনেকে এই নতুন নিয়মের পিছনে নিয়োগ কমানোর অভিসন্ধি দেখছেন। ‘‘এই ধরনের নির্দেশিকা জারির অর্থ পদ কমানো। নিয়োগের সম্ভাবনা দিনে দিনে কমিয়ে আনার জন্যই এমন সিদ্ধান্ত,’’ বলছেন শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার।

অন্য বিষয়গুলি:

UGC University Teaching
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy