মৃত অমৃতা পারিয়ার। ছবি: রবিন রাই।
দার্জিলিঙের বাড়ি ধসে মৃত্যু হল ৭ জনের। জখম অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ৮ জনকে। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার সন্ধ্যে ৬টা পর্যন্ত উদ্ধারকাজ চলেছে। রাতেই তিন জনের দেহ উদ্ধার হয়েছিল। বিকেলে নিখোঁজ তিন জনের দেহ মেলার পরে উদ্ধারকাজ শেষের কথা ঘোষণা করা হয়। প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, এ দিন সন্ধ্যায় শেষে যে তিন জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে, তাঁরা হলেন নাসিমা বানু (৩৫), জামিলা বানু (৬৫) এবং কাশ্মীরি আলি (৪০)। এঁরা সকলেই একই পরিবারের বলে জানা গিয়েছে। এর আগে বিকেলে উমে হাবিবার (২৮) দেহও উদ্ধার করেছে সেনা জওয়ানেরা।
শনিবার বিকেলে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দার্জিলিঙে পৌঁছন। তিনি বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়তে এসেছি। রাজ্যের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়েছে।’’ দার্জিলিঙের পুরনো জরাজীর্ণ বহুতলগুলি নিয়ে জিটিএ এবং প্রশাসনকে কড়া পদক্ষেপ করতে হবে বলে রবিবাবু এ দিন দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘জিটিএ এবং প্রশাসন বিপজ্জনক বহুতল নিয়ে পদক্ষেপ করলে রাজ্যের তরফে যাবতীয় সাহায্য করা হবে।’’
বস্তুত, গোটা দার্জিলিং জুড়ে কোথাও দোতলা বাড়ির উপরে তিনতলা বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। কোথাও বিনা অনুমতিতে তিনতলার উপরে আরও দু’তলা বানানো হচ্ছে। পুরসভা-প্রশাসনের অনুমতির তোয়াক্কা না করে এমন দিনের পর দিন ঘটছে বলে অভিযোগ। পাহাড়ি এলাকায় বিধি ভেঙে একের পর এক ছাদ ঢালাই হওয়ায় নানা মহলেই বিপদের আশঙ্কা করা হচ্ছিল। সেটাই যেন সত্যি হল শুক্রবার রাতে। চারতলা বাড়ি ধসে দার্জিলিঙে মৃত্যু হল সাত জনের। পুরসভা-প্রশাসনের অনেকেই একান্তে সে কথা মানছেনও।
পুরসভা-প্রশাসন সূত্রের খবর, শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ দার্জিলিঙের জাকির হোসেন বস্তি (বুচার বস্তি নামেও পরিচিত) এলাকার চারতলা বাড়িটি ধসে পড়ে। ধসে চাপা পড়ে যান শিশু ও বৃদ্ধ-সহ বাড়ির ১৬ জন বাসিন্দা। এও দিন দুপুরে উদ্ধার হয় এক সন্তানসম্ভবা মহিলা-সহ দুই শিশুও।
জেলা প্রশাসন, জিটিএ-র উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে সেনা জওয়ান এবং বিএসএফের জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর জওয়ানরাও উদ্ধারকাজে হাত লাগান। গভীর রাতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্ধারকাজের খোঁজখবর নেন। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ জানান, রাজ্য সরকারের তরফে মৃতদের ২ লক্ষ এবং আহতদের ১ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করা হয়েছে। জিটিএ-র তরফেও মৃতদের ২ লক্ষ এবং আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। দার্জিলিং পুরসভাও জখমদের ৫০ হাজার টাকা দেবে বলে জানানো হয়েছে।
বাড়িটির তিনতলার বাসিন্দা এক দম্পতি এবং তাঁদের বৃদ্ধা মায়ের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃতেরা হলেন নাম রাজেশ পারিয়ার (৪৫), তাঁর স্ত্রী অনিতা (৩৮) এবং রাজেশবাবুর মা অমৃতাদেবী (৬০)। মৃত দম্পতির ৯ বছরের মেয়ে অঞ্জলিকে স্তূপের নীচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। অঞ্জলিকে দার্জিলিং জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। সে সুস্থ রয়েছে বলে প্রশাসনের দাবি। ওই পরিবারের আরও এক জন রক্ষা পেয়েছেন। রাজেশবাবুর বাবা দীপকবাবু তীর্থ করতে দার্জিলিঙের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছেন।
বাসিন্দারা দাবি করেছেন, প্রতি বছর বর্ষাতেই দেওয়াল চুঁইয়ে জল ঢুকত। দার্জিলিং পুরসভার প্রাথমিক সমীক্ষাতেও ষাটের দশকে তৈরি বাড়িটিকে ‘বিপজ্জনক’ বলে দাবি করা হয়েছিল। তার পরেও কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। সে কারণে প্রশ্ন উঠেছে পুরসভার ভূমিকা নিয়েও। পুরসভার দাবি, কেন বাড়ি ভাঙল তা খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিটি তৈরি হয়েছে। তবে শুধু বিপজ্জনক বহুতল নয়, সরু গলির রাস্তা ক্রমাগত অপরিকল্পিত নির্মাণে ঘিঞ্জি হয়েছে। তার জেরে উদ্ধারকাজেও সমস্যা হচ্ছে বলে বলে প্রশাসনের তরফে দাবি করা হয়েছে। দার্জিলিঙের জেলাশাসক অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেন, ‘‘ধসের খবর পাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে উদ্ধারকাজ শুরু হয়ে যায়। দেরি না করে সেনাবাহিনী, জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকেও তলব করা হয়। তবে এলাকাটি এতটাই ঘিঞ্জি যে উদ্ধারকাজে খুব সমস্যা হচ্ছে।’’ জেলাশাসক বলেন, ‘‘প্রাথমিক কাজ হয় সকলকে উদ্ধার করা। পরে বাড়ি ভাঙার কারণ খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করা হবে।’’
ধসে যাওয়া বাড়িটির তিনতলা পর্যন্ত কংক্রিটের। চতুর্থ তলটি কাঠের তৈরি। চার তলায় কোনও বাসিন্দা থাকতেন না বলে দাবি করা হয়েছে। বাড়ির তিনতলায় মোট তিনটি পরিবার ভাড়া থাকত বলে পুলিশ জানিয়েছে। সাড়ে ১০টা নাগাদ বিকট শব্দ পেয়ে আশপাশের বাসিন্দারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। এলাকার বাসিন্দা আশরাফ হোসেন বলেন, ‘‘বাইরে গিয়ে দেখি গোটা বাড়িটাই যেন মাটিতে মিশে গিয়েছে। ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে চাপা আর্তনাদ ভেসে আসছে। বাসিন্দাদের পরিণতি কী হতে চলেছে জেনে আতঙ্কে শিউরে উঠেছিলাম।’’
দোতলায় থাকতেন গুলাম হোসেনের পরিবার। গুলামের ২১ বছরের মেয়ে সবিতা খাতুন সন্তানসম্ভবা বলে জানা গিয়েছে। তাঁদের সকলকেই প্রথমে উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনার আধ ঘণ্টার মধ্যে গুলাম, তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলে এবং নাতনিকে উদ্ধার করা হয়। ছোট ছেলে মহম্মদ সালামকে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে এবং সাত বছরের নাতনি ইবাকে শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি করানো হয়েছে। বাড়ির নীচতলায় পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন শাহ। তাঁকে এ দিন ভোর ৬টা নাগাদ উদ্ধার করা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নীচে প্রায় সাত ঘণ্টা চাপা পড়েছিলেন তিনি। তাঁর দু’পা এবং মাথায় চোট লেগেছে। দার্জিলিং সদর হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে।
পুলিশ জানিয়েছে, বাড়ির মালিকের নাম অশোক ছেত্রী। বাড়ির মালিক দার্জিলিঙে থাকতেন না। মাস ছয়েক হল তাঁরা শিলিগুড়ির বাসিন্দা। বাড়ি ভেঙে পড়ার খবর পেয়ে অশোকবাবুর স্ত্রী মুন্নাদেবী রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ দার্জিলিঙে পৌঁছন। তিনি বলেন, ‘‘অনেক দিন ধরেই আমরা শিলিগুড়িতে থাকি। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। এর বেশি এখন আর কিছু বলার নেই।’’
আরও পড়ুন:
বন্যার আতঙ্কে দিশেহারা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy