দুর্ঘটনাগ্রস্ত সেই গাড়ি। বুধবার টিহরীতে। ছবি: টিহরী প্রশাসনের সৌজন্যে প্রাপ্ত।
বার বার ফোন করা হচ্ছিল। কিন্তু তা শুধু বেজেই যাচ্ছিল। কেউ ফোন না-তোলায় চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন এগিয়ে যাওয়া গাড়ির সঙ্গীরা। বুঝতে পারছিলেন না, পিছনের গাড়ির লোকজন ফোন ধরছেন না কেন। কিছু পরে অবশ্য কেউ সেই ফোন ধরলেন এবং হিন্দিতে দিলেন দুঃসংবাদ, “দুর্ঘটনায় গাড়ি নীচে পড়ে গিয়েছে। মনে হয়, কেউ আর বেঁচে নেই। আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন।’’
উত্তরাখণ্ডে ট্রেকিংয়ে গিয়ে টিহরী গাড়োয়াল এলাকায় বুধবার দুপুরে পাহাড় থেকে গাড়ি নীচে পড়ে মৃত্যু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের পাঁচ পর্যটকের। মারা গিয়েছেন তাঁদের ভাড়ার গাড়ির চালকও। নিউ টিহরী থানার পুলিশ জানিয়েছে, দুর্ঘটনায় মৃতদের নাম মদনমোহন ভুঁইয়া (৬১), ঝুমুর ভুঁইয়া (৫৯) ও নীলেশ ভুঁইয়া (২৩) (বাবা-মা ও ছেলে), দেবমাল্য দেবনাথ (৪৪) ও প্রদীপ দাস (৪৭)। ভুঁইয়া পরিবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার নরেন্দ্রপুর থানার শ্রীনগরের বাসিন্দা। রেলের ইঞ্জিনিয়ার প্রদীপের বাড়ি নৈহাটিতে এবং ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরির কর্মী দেবমাল্য ব্যারাকপুরের বাসিন্দা। গাড়িচালক আশিসের বাড়ি উত্তরকাশীতে। দুর্ঘটনার খবর পৌঁছতেই নরেন্দ্রপুর থেকে নৈহাটি, ব্যারাকপুর— সর্বত্রই নেমে আসে শোকের ছায়া।
উত্তরাখণ্ড পুলিশ সূত্রের খবর, বঙ্গের ১১ জন পর্যটক দু’টি গাড়িতে উত্তরকাশী হয়ে গঙ্গোত্রীর দিকে যাচ্ছিলেন। বেলা সাড়ে ৩টে নাগাদ গঙ্গোত্রী হাইওয়েতে কণ্ডীসোড় তহশিলের কাছে কোটীগাড় এলাকায় পাকদণ্ডীতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি গাড়ি প্রথমে নীচের রাস্তায় আছড়ে পড়ে। সেখান থেকে গড়িয়ে আরও নীচে প্রায়-শুকনো নদীতে পড়ে আগুন ধরে যায় গাড়িটিতে। টিহরীর পুলিশ অফিসারেরা জানান, ছ’টি মৃতদেহের মধ্যে তিনটি গাড়িতে থাকায় পুরো পুড়ে গিয়েছে। তিনটি দেহ মেলে গাড়ির বাইরে। অনুমান, ওই তিন জন ছিটকে গাড়ির বাইরে গিয়ে পড়েন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানোর পরে চিকিৎসকেরা তাঁদের সকলকেই মৃত ঘোষণা করেন।
দুর্ঘটনাস্থলে থাকা টিহরী পুলিশের এসআই রাজেন্দ্র সিংহ রাওয়ত বলেন, ‘‘গাড়িটিতে কী ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছিল, পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।’’ তদন্তকারীদের ধারণা, গাড়িটি পাহাড়ি রাস্তা থেকে নদীপাড় পর্যন্ত প্রায় ১০০ ফুট আছাড় খেতে খেতে পড়ার ফলে জ্বালানি (ডিজ়েল) ট্যাঙ্ক ফেটে যাওয়াতেই আগুন ধরে যায়। আবার এটাও মনে করা হচ্ছে যে, ওই ট্রেকারদের সঙ্গে থাকা সিলিন্ডার ফেটে আগুন ধরে থাকতে পারে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, আচমকাই বিকট শব্দে গাড়িটি পাহাড়ি ঢালের ঝোপজঙ্গল ভেদ করে নদীর কাছে এসে পড়ার পরেই তাতে আগুন ধরে যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জল ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন এবং থানায় খবর দেন। পুলিশ ও উদ্ধারকারী দল সেখানে চলে আসে।
কুশল বসু নামে ট্রেকারদলের এক সদস্য ফোনে জানান, সকালে তাঁরা সকলে হরিদ্বার ও হৃষীকেশের মধ্যে রায়বালা স্টেশনে জড়ো হন। সেখানে অপেক্ষা করছিল ভাড়ার দু’টি গাড়ি। আশিসের গাড়িতে স্ত্রী ঝুমুর ও ছেলে নীলেশকে নিয়ে ওঠেন মদনবাবু। তাঁদের সঙ্গী হন প্রদীপ ও দেবমাল্য। অন্য গাড়িতে ছিলেন কুশল-সহ বাকি পাঁচ জন। গঙ্গোত্রী হাইওয়ে ধরে উত্তরকাশী হয়ে রাতের মধ্যে গঙ্গোত্রী পৌঁছনোর কথা ছিল। গোমুখ থেকে কেদারতাল ট্রেকিংয়ের পরিকল্পনা ছিল। কুশল জানান, এ দিন দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে তাঁরা ফের রওনা দেন। সেই সময় তাঁদের গাড়িটা বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল।
কুশল বলেন, ‘‘পিছনের গাড়িটির দেরি হচ্ছে কেন, জানতে বার বার করে ফোন করছিলাম। কিন্তু কেউ ফোন তুলছিলেন না। খুব চিন্তা হচ্ছিল। তার পরেই কেউ এক জন ফোনটা ধরে দুর্ঘটনার খবর দেন।’’ প্রায় ১৪ কিলোমিটার পথ পিছিয়ে পাহাড়ি গ্রামের রাস্তা ধরে ওই নদীর কাছে পৌঁছন কুশলেরা। তিনি জানান, গত বছর কাশ্মীরে গিয়ে পরিচয় হয় পেশায় গ্রন্থাগারিক মদনবাবুর সঙ্গে। সকলেই ভ্রমণপিপাসু হওয়ায় তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়তে থাকে। সেই থেকেই এ বার কেদারতাল ট্রেকিংয়ের পরিকল্পনা। কুশল বলেন, ‘‘মদনবাবুরাতিন জনে দিল্লি হয়ে হরিদ্বার চলে আসেন। সেখান থেকে এ দিন সকালে রায়বালা স্টেশনে এসেআমাদের সঙ্গে যোগ দেন। আমরা এ দিন সকালেই ওই স্টেশনে এসে নেমেছিলাম।’’
দুর্ঘটনার পরে মৃতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন কুশল। স্বজনদের যত শীঘ্র সম্ভব উত্তরাখণ্ডে পৌঁছতে অনুরোধ করা হয়েছে। পুলিশ জানায়, সব মৃতদেহ গভীর রাতে এমসে পাঠানো হয়েছে। ময়না-তদন্তের পরে মৃতদেহ পরিজনের হাতে তুলে দেওয়া হবে। কুশল-সহ বাকি পাঁচ পর্যটক একটি হোটেলে আছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy