Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Didir Suraksha Kavach

বাংলার কি সাহস বেড়ে গিয়েছে? তিন কারণে ‘দিদির দূত’ তৃণমূল নেতারা রোজ বিক্ষোভের মুখে

শুরুর দিন থেকেই ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচি নিয়ে সফরে যাওয়া তৃণমূল নেতারা বিক্ষোভের মুখে। এমন ধারাবাহিক ক্ষোভ তো অতীতে দেখা যায়নি! কেন এমন হচ্ছে? ভাবাচ্ছে শাসকদলকেও।

১১ জানুয়ারি শুরু হয়েছে ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচি।

১১ জানুয়ারি শুরু হয়েছে ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচি। — ফাইল চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৩ ২০:০২
Share: Save:

‘জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।’ কথা বলতে পারলে তৃণমূলের ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই লাইনটি হয়তো বলেই ফেলত। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে বাংলার শাসকদলের এই কর্মসূচি শুরুর দিন থেকেই নানা ক্ষোভ-বিক্ষোভের মুখে। একের পর এক নেতাকে সামাল দিতে হচ্ছে সাধারণের ক্ষোভ। ‘মানুষের ক্ষোভ জানার জন্যই তো এই কর্মসূচি’ বলে দাবি করলেও ‘অস্বস্তি’ ঢাকতে পারছেন না তৃণমূল নেতৃত্ব।

কিন্তু কেন এমন হল? টানা তিন বার যে দল রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছে (প্রতি বারই আসন এবং ক্ষমতা বাড়িয়ে) তার সাংসদ, বিধায়কদের সামনে এমন লাগাতার সরব দাবিদাওয়া এবং ক্ষোভ তো অতীতে দেখা যায়নি! পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে অন্তত তিনটি কারণ বোঝা যাচ্ছে।

অতীতে এমন হয়নি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে বিজেপি ১৮টি আসন পাওয়ার পর রাজনৈতিক পরামর্শদাতা প্রশান্ত কিশোরের (পিকে) পরিকল্পনা মতো চলতে শুরু করে তৃণমূল। নেওয়া হয় ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি। তখনও তৃণমূল নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়েছেন, কর্মীদের বাড়িতে খেয়েছেন, বুথ স্তরে রাত্রিবাস করেছেন। কিন্তু এ ভাবে দিনের পর দিন তাঁদের জনতার ক্ষোভ-বিক্ষোভের মুখোমুখি হতে হয়নি।

‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচির অবশ্য একটি বৈশিষ্ট্যগত ফারাক ছিল। তাতে নির্দিষ্ট একটি ফোন নম্বরে অভিযোগ জানানোর সুযোগ ছিল। পিকের সংস্থার কর্মীদের ‘কল সেন্টার’ মারফত সেই সব অভিযোগ পৌঁছত তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। ফোনে কে কী বলছেন তার কিছু ‘কল রেকর্ড’ প্রকাশ্যে এলেও কথোপকথনের বেশিটাই গোপন ছিল। তৃণমূল সূত্রের খবর, তখন ফোনে বেশির ভাগ অভিযোগই মিলেছিল ব্যক্তিগত চাওয়া, না-পাওয়া নিয়ে। কিন্তু ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচিতে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন গাঁ-গঞ্জের মানুষেরা। দল বেঁধে কথা বলতে আসায় ব্যক্তিগত দাবির চেয়ে সামগ্রিক দাবিদাওয়া ও অভিযোগ প্রাধান্য পাচ্ছে। ‘দিদিকে বলো’-তে ছিল এক স্বরের অভিযোগ। ‘দিদিত দূত’-কে সামনে পেয়ে বহু স্বর একত্রিত হয়ে উচ্চকিত হয়ে উঠছে।

পুরুলিয়ায় গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন সাংসদ অর্জুন সিংহ।

পুরুলিয়ায় গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন সাংসদ অর্জুন সিংহ। — ফাইল চিত্র।

ক্ষোভপ্রকাশের প্রথম কারণই হল কথা বলার সুযোগ পাওয়া। তৃণমূলের পক্ষে এই কর্মসূচির পরিকল্পনায় শোনার চেয়ে নেতাদের বলার কথাই বেশি ছিল। ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ মানে রাজ্য সরকারের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের কথা মানুষের কাছে গিয়ে বলা। উপভোক্তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলে তৃণমূল সরকারের গুণগান করার লক্ষ্যই ছিল শাসকদলের। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বলার চেয়ে নেতাদের শুনতে হচ্ছে বেশি। সাধারণ মানুষ স্থানীয় সমস্যার কথা বলতে গিয়ে বড় নেতা, বিধায়ক, সাংসদদের কাছে স্থানীয় নেতাদের সম্পর্কে নালিশ করছেন। সুযোগ কাজে লাগানোর এই তাগিদই অনেক ক্ষেত্রে ক্ষোভ-বিক্ষোভের চেহারা নিচ্ছে। পঞ্চায়েত স্তরের অভিযোগ উচ্চ নেতৃত্বকে জানানোর ক্ষেত্র হিসাবে এই কর্মসূচিকে বেছে নিচ্ছেন অনেক তৃণমূল স্তরের তৃণমূলকর্মীও। আবার পঞ্চায়েতকে বলে বলেও কোনও পরিষেবা না পাওয়া নিয়েও সাধারণ মানুষ মুখ খুলছেন। আবার আবাস যোজনা নিয়েও পাওয়া বা না পাওয়ার অভিযোগ বিস্তর। আগে থেকেই নেতাদের কর্মসূচি জানা থাকায় ‘প্রশ্নবাণ’ নিয়েও তৈরি থাকছেন অনেকে। কিছু ক্ষেত্রে বিরোধীদের উস্কানিও থেকে থাকতে পারে। তবে ক্ষোভ-বিক্ষোভকে বেশি করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে বীরভূমে ‘দিদির দূত’ শতাব্দীর খাবার ফেলে উঠে যাওয়া বা উত্তর ২৪ পরগনার দত্তপুকুরে ক্ষোভ জানাতে আসা ব্যক্তিকে এক তৃণমূল কর্মীর চড় মারার ঘটনা।

প্রথম কারণটি ‘শুভ’ নয় বলে মানলেও বিক্ষোভের পিছনে দ্বিতীয় কারণটি তৃণমূলের পক্ষে ‘ভাল’ও হতে পারে বলে মনে করছেন দলের নেতাদের একটি অংশ। তাঁদের দাবি, এক শ্রেণির তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে দলের নীচু তলার কর্মীর অনেক অভিযোগ রয়েছে। পঞ্চায়েত থেকে জেলা স্তরের সেই নেতাদের সম্পত্তিবৃদ্ধি নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সঙ্গত ক্ষোভ রয়েছে। সাধারণ কর্মী ও মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। কলকাতার দলীয় নেতৃত্ব সেই নেতাদের সম্পর্কে যতটা জানেন, তার চেয়ে বেশি জানেন স্থানীয়েরা। সম্প্রতি একাধিক ক্ষেত্রে এই ধরনের অভিযোগ জেনে দল পদক্ষেপ করেছে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে পদ খোওয়াতে হয়েছে কয়েক জন জনপ্রতিনিধিকে। তা আরও বেশি করে অভিযোগ ও ক্ষোভপ্রকাশে উৎসাহ জোগাচ্ছে।

বিতর্ক বাড়িয়ে দিয়েছে দু’টি ঘটনা।

বিতর্ক বাড়িয়ে দিয়েছে দু’টি ঘটনা। — ফাইল চিত্র।

এই কর্মসূচির মাধ্যমে দলের ভিতরের ‘আবর্জনা’ পরিষ্কারেরও লক্ষ্য রয়েছে তৃণমূলের। সাধারণের মুখ থেকে শোনা ক্ষোভ, অভিযোগ সেই ঝাড়াইবাছাইয়ে সাহায্য করতে পারে। আবার কোন জনপ্রতিনিধি কতটা কাজের এবং সাধারণ মানুষের কতটা কাছের তারও একটা ইঙ্গিত মিলতে পারে এই কর্মসূচির মাধ্যমেই। তাই এখন ‘ক্ষোভ’, ‘অভিযোগ’ শোনা নিয়ে সাময়িক অস্বস্তি থাকলেও তা দলকে স্থায়ী সুরাহার পথ দেখাতে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক ঘটনাবলির তৃতীয় কারণ বদলে যাওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি। শাসক তৃণমূলের কাছে সেটাই সবচেয়ে বেশি চিন্তার কারণ হয়ে উঠতে পারে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতারি, শিক্ষায় দুর্নীতি নিয়ে ঘটতে-থাকা ঘটনাপ্রবাহে গত কয়েক মাসে তৃণমূলের ভাবমূর্তি বদলে গিয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে। রাজ্য সরকারের প্রকল্প নিয়ে ‘দিদি’-র প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকলেও ‘দল’ হিসেবে তৃণমূল নিয়ে একটা অভিযোগ এবং অনুযোগের পরিসর তৈরি হয়েছে।

টেট, স্লেট পরীক্ষা-সহ শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির যে ছবি এখনও পর্যন্ত প্রচারে এসেছে, তা নিয়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ। তৃণমূলের অনেকে এমনও মনে করছেন, সেই ঘায়ে সবচেয়ে বেশি নুন ছিটিয়েছে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমে বিপুল অর্থ উদ্ধার। এ ভাবে ঘরের ভিতর নোটের পাহাড় বানিয়ে রাখার ছবি আগে দেখেনি বাংলা। সম্প্রতি তৃণমূল বিধায়ক জাকির হোসেনের বাড়ি থেকে বড় অঙ্কের নগদ উদ্ধার ভোটারদের তাঁদের প্রতি আরও বিরূপ করে তুললে পারে বলে দলের একাংশের আশঙ্কা। জাকির বা তৃণমূল নেতারা যা-ই যুক্তি দিন, বিপুল অঙ্কের টাকা উদ্ধার হলেও পার্থ-কাণ্ডের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের।

তৃণমূল নেতারা বলছেন, ‘‘হাতি যখন কাদায় পড়ে, চামচিকেতেও লাথি মারে। জোকা ইএসআই হাসপাতালে পার্থকে যে মহিলা জুতো ছুড়ে মারলেন, তিনি কি আগে সেটা করার কথা ভাবতে পারতেন? আগে যাঁরা সব দেখেও চুপ থাকতেন, তাঁরাও এখন সরব। এঁদের মধ্যে অনেক বঞ্চিত যেমন আছেন, তেমনই সব রকম রাজনৈতিক সুবিধা-নেওয়া লোকজনও আছেন। হয়তো সামনে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু পিছন থেকে বিক্ষোভে মদত দিচ্ছেন।’’

দলের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে ওই নেতার আরও যুক্তি, ‘‘এটাও ঠিক যে, তৃণমূল বলেই এটা সম্ভব। বিজেপি বা সিপিএম ক্ষমতায় থাকলে মানুষ এতটা নির্ভয় হতে পারতেন কি?’’ নেতাদের তরফে এমন দাবি করা প্রত্যাশিত। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাঁরাও জানেন, শাসকের প্রতি ‘ভয়ভক্তি’ খানিক কমেছে। বীরভূম জেলায় সাংসদ শতাব্দী রায় বা বাকিদের যে হেনস্থা হতে হয়েছে, সেটা অনুব্রত মণ্ডল স্বমহিমায় নিজের জেলায় উপস্থিত থাকলে সম্ভব হত না।

এখন দেখার, ‘দিদির দূত’-দের ঘিরে এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ তৃণমূল সামাল দিতে পারে কি না। নাকি বিষয়টি আরও গড়াতে থাকে। বিক্ষোভের প্রকোপ বাড়লে বলতে হবে, ভয় এবং ভক্তি সত্যিই কমছে জনতার।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy