গোবরডাঙা খাঁটুরা উচ্চ বিদ্যালয়। Sourced by the ABP
শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার কয়েকশো বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে গোবরডাঙা শহর। বাসিন্দাদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল, শহরটিকে ‘হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হোক। সম্প্রতি রাজ্য হেরিটেজ কমিশন গোবরডাঙার কয়েকটি স্থাপত্যকে হেরিটেজ ঘোষণা করেছে। পুরসভা সূত্রে জানানো হয়েছে, প্রসন্নময়ী কালীমন্দির, চণ্ডীতলা জোড়া শিবমন্দির, সিংহ দুয়ার, নহবতখানা ও গোবরডাঙা খাঁটুরা হাইস্কুলকে ‘হেরিটেজ’ তকমা দেওয়া হয়েছে। পুরপ্রধান শঙ্কর দত্ত বলেন, “রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের এই সিদ্ধান্তে আমরা, খুবই খুশি। এই ঘোষণার পরে গোবরডাঙায় পর্যটনশিল্পে জোয়ার আসবে বলে মনে করি।”
পুরসভার তরফে জানানো হয়েছে, যাঁদের সংরক্ষণে স্থাপত্যগুলি রয়েছে, তাঁদের কাছ থেকে কয়েক মাস আগে হেরিটেজ কমিশনের তরফে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ চাওয়া হয়েছিল। তা পাওয়ার পরে কমিশনের তরফে আরও একটি চিঠি দিয়ে স্থাপত্যগুলিকে হেরিটেজ ঘোষণার কথা জানানো হয়েছে।
শহরের প্রবীণ বাসিন্দা পবিত্র মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই ঘোষণা একটা বড় প্রাপ্তি। আশা করব, ঐতিহ্যগুলির সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ হবে। পাশাপাশি, কমিশনের কাছে আবেদন, বাকি ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যকেও হেরিটেজ ঘোষণা করুন।”
অতীতে কুশদ্বীপের অংশ ছিল আজকের গোবরডাঙা শহর। দেশের অন্যতম প্রাচীন হাইস্কুল গোবরডাঙা খাঁটুরা হাইস্কুল স্থাপিত হয় ১৮৫৬ সালে। গোবরডাঙা হাই ইংলিশ স্কুল ও খাঁটুরা মিডল ইংলিশ স্কুল দু’টি একত্রে তৈরি হয়েছিল খাঁটুরা উচ্চ বিদ্যালয়। এলাকার শিক্ষা প্রসারে স্কুলটির অবদান অনেকখানি। স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক বিশ্বনাথ রায় বলেন, “হেরিটেজ ঘোষণায় স্কুলের কর্তৃপক্ষ ও পড়ুয়ারা সকলে খুশি। তবে স্কুলের ২১০০ ছাত্রের জন্য পর্যাপ্ত ঘর নেই। সরকারি সাহায্য পেলে আরও ভবন তৈরি করা যাবে।”
খাঁটুরার বাসিন্দা সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যের অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহযোগী। ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন সরকারি অনুমোদন পাওয়ার পরে শ্রীশচন্দ্র প্রচলিত সংস্কার উপেক্ষা করে ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে বর্ধমানের বাল্যবিধবা কালীমতীকে বিয়ে করেন। নিজের মায়ের নিষেধও মানেননি তিনি। ওটিই ছিল প্রথম বিধবা বিবাহ। বিবাহবাসরে উপস্থিত ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রমাপ্রসাদ রায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহের মতো দিকপালেরা। পবিত্র জানান, শ্রীশচন্দ্র তাঁর মায়ের স্মৃতিতে চণ্ডীতলায় জোড়া শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
অধুনা বাংলাদেশের যশোর জেলার সারসা থেকে গোবরডাঙায় এসে বসতি গড়েছিলেন খেলারাম মুখোপাধ্যায়। গোবরডাঙার মুখোপাধ্যায় জমিদার বংশের পত্তন করেন তিনি। গাইঘাটার ইছাপুরে ছিল তাঁর মামার বাড়ি। কথিত আছে, যশোরের কালেক্টর সাহেবের সেরেস্তার কাজে যুক্ত হন খেলারাম। কালেক্টরের আগ্রহ ও পরামর্শে খেলারাম গোবরডাঙা নিলামে কেনেন। কথিত আছে, মা কালীর আশীর্বাদে খেলারামের পুত্রসন্তান লাভ হয়। ছেলের নাম রাখেন কালীপ্রসন্ন। তারপর থেকে বংশের প্রত্যেক ব্যক্তির নামের সঙ্গে ‘প্রসন্ন’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হত। খেলারাম স্বপ্নে দেখা দেবী মূর্তির আদলে মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে প্রসন্নময়ী কালীমন্দির তৈরির কাজ শুরু করেন। তবে মন্দির সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যান তিনি।
কালীপ্রসন্ন ১২২৯ বঙ্গাব্দে প্রসন্নময়ী কালীমন্দির ও বারোটি শিবমন্দির স্থাপন করেন। কালো কষ্টিপাথরের কালীমূর্তি ও শ্বেত পাথরের শিব খুবই জনপ্রিয়।প্রসন্নময়ী কালীমন্দির প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৩৩ বছর পরে দক্ষিণেশ্বরেরভবতারিণী মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। একবার এই এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময়ে প্রসন্নময়ী কালীমন্দিরে এসেছিলেন রানি রাসমণি।
বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গন্ধর্বপুরে ব্রাহ্মমন্দির, সাহাপুরের মঙ্গলালয়, নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ, গৈপুরের ওলাবিবির দরগা, কুণ্ডুপুকুরের শিবমন্দির, খাঁটুরার জোড়া শিবমন্দির, গড়পাড়া ও রঘুনাথপুরের মসজিদের মতো বহু স্থাপত্য এখনও বহন করে চলেছে প্রাচীন ইতিহাস। এগুলিও হেরিটেজ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় মানুষ। ছবি: সুজিত দুয়ারি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy