এই পুকুরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে চিংড়ি চাষ। নিজস্ব চিত্র
ভেনামি চিংড়ি চাষে মন্দা দেখা দিয়েছে হিঙ্গলগঞ্জ-হাসনাবাদের বিভিন্ন এলাকায়। কয়েক বছর আগেও এই সব এলাকায় প্রচুর হারে ভেনামি চিংড়ি চাষ হচ্ছিল। চিংড়ি চাষকে কেন্দ্র করে ব্যবসা হচ্ছিল কোটি কোটি টাকার। কিন্তু স্থানীয় সূত্রের খবর, সম্প্রতি চিংড়ি চাষ প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দলে দলে ভিন্ রাজ্যে কাজে চলে যাচ্ছেন অনেকে। চিংড়ি চাষ বন্ধের প্রভাব পড়ছে এলাকার অর্থনীতিতে।
হিঙ্গলগঞ্জের বিশপুর পঞ্চায়েত এলাকাতেই প্রায় এক হাজার পুকুরে ভেনামি চিংড়ি চাষ হতো। কিন্তু এ বছর ছ’শো পুকুরেই চাষ হচ্ছে না। গত কয়েক বছর অনেক নতুন পুকুর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এ বার একটিও নতুন পুকুর হয়নি। কেন এই অবস্থা?
স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, করোনা পরিস্থিতিতে বড় প্রভাব পড়েছে চিংড়ি চাষে। ২০২০ সালে করোনা ও লকডাউনের জেরে চাষ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২০২১ সালে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা হয়। কিন্তু সে বার ইয়াসের জেরে নদীবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকায় নোনাজল ঢুকে পড়ে। চাষ পুরো নষ্ট হয়ে যায়। চিংড়ির রোগের প্রকোপও দেখা দেয় এই সময়ে। পর পর দু’বছর ব্যবসা খারাপ হওয়ায় অনেকেই এ বার আর চিংড়ি চাষের ঝুঁকি নেননি। অনেকে ঋণ নিয়ে দু’বছর চাষ করেছিলেন। সেই টাকা শোধ করতে না পেরে চাষ ছেড়ে আয়ের খোঁজে পাড়ি দিয়েছেন ভিন্ রাজ্যে। কেউ কেউ খুব অল্প পরিমাণে চাষ করছেন।
বিশপুরের পুরোনো চিংড়ি চাষি প্রবীর মণ্ডল বলেন, “আমার ২২টি পুকুর ছিল। গত দু’বছর পর পর আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছি। ফলে এবার আর অত পুকুরে চাষ করার ক্ষমতা নেই। তাই মাত্র তিনটি পুকুরে চাষ করছি কোনও রকমে।” বিশপুরে মাছের খাবার ও ওষুধের দোকানও রয়েছে প্রবীরের। এলাকার চাষিরা সেখান থেকেই মাছের ওষুধ খাবার নিতেন। প্রবীরের কথায়, “যাঁরা মাল নিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই টাকা শোধ করতে পারেননি। প্রায় দু’কোটি টাকা বাকি। বেশির ভাগই চাষ ছেড়ে তামিলনাড়ুতে কাজে চলে গিয়েছেন। টাকা শোধ করতে না পেরে তাঁদের পুকুর আমাকে দিয়ে গিয়েছেন। এ দিকে চাষের ক্ষতি হওয়ায় আমিও ঋণে জর্জরিত। এই সঙ্কট থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পাচ্ছি না।”
আর এক চাষি অর্ধেন্দু ঘোষের কথায়, “১২টি পুকুর ছিল। ২টি পুকুর বিক্রি করে দিয়েছি। ৫টি পুকুরে চাষ করছি না। বাকি ৫টি পুকুরে খরচ কমাতে অর্ধেক পরিমাণ মাছ ছেড়ে কোনওরকমে চাষ করছি। জমি মালিকদের লিজের টাকাও দিতে পারব না। খুব খারাপ অবস্থা ব্যবসার।”
চাষ ছেড়ে তামিলনাড়ুতে কাজে চলে গিয়েছেন বিশপুর গ্রামের বাসিন্দা আশিস পাত্র। তাঁর কথায়, “এ বছর থেকে চাষ করছি না। বাজারে প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা ঋণ হয়েছে। বাড়িতে লোক এসে চড়াও হন। তাই কিছুদিন ধরে তামিলনাড়ুতে এসে একটি সংস্থায় কাজ করছি। ঋণ শোধ না করে গ্রামে ফিরব কী করে সেটাই চিন্তা।”
ধরমবেড়িয়া গ্রামের মৎস্যচাষি রাখিগোপাল মণ্ডল জানালেন, তিনিও এ বছর থেকে ভেনামি চিংড়ি চাষ করেননি। ছেলে বেঙ্গালুরুতে শ্রমিকের কাজে গিয়েছেন। তিনি নিজে কলকাতায় নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করছেন। রাখিগোপাল বলেন, “বাজারে প্রায় ৮ লক্ষ টাকা ঋণ। সুদে টাকা নিয়ে চাষ করতে নেমেছিলাম লাভের আশায়। এত ক্ষতি হয়েছে, চাষ বন্ধ করে কিছুদিন আগে কলকাতায় চলে এসেছি। জানি না, ঋণের টাকা কী ভাবে শোধ করব।”
হাসনাবাদের মাছের খাবার ও ওষুধের দোকানের মালিক গৌতম পাত্র জানালেন, গত বছরও প্রায় ৩৫ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল। কিন্তু এ বার বহু চাষি চাষ ছেড়ে দেওয়ায় অর্ধেকও হয়নি।
ভেনামি চিংড়ি চাষের সঙ্গে পরোক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন বহু মানুষ। অনেকে মালপত্র বইতেন ভ্যানে, পুকুর দেখভাল করতেন অনেকে, মুটে হিসেবেও কাজ করে আয় করতেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে তাঁদের অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। ভিন্ রাজ্যে চলে যাচ্ছেন তাঁরাও, জানালেন গ্রামবাসীরা।
হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের মৎস্য আধিকারিক সৈকত দাস বলেন, “মৎস্যজীবী ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণ মিলতে পারে সর্বোচ্চ ২ লক্ষ টাকা। তার জন্য অনেকে আবেদন করেছেন। এছাড়া বঙ্গ মৎস্য যোজনা নামে একটি প্রকল্প চালু হয়েছে। আবেদনপত্র জমা নেওয়া চলছে। সেখানে তফসিলি জাতি-উপজাতি বা মহিলা হলে সর্বোচ্চ ৪ লক্ষ টাকার প্রকল্পের উপরে সরকার ৬০ শতাংশ ভর্তুকি দেবে। অন্যদের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy