ফাঁকা: দোকানপাটে ভিড় জমল না এখনও। ক্যানিংয়ে তোলা নিজস্ব চিত্র
পুজোর কেনাকাটায় ভাটার টান দক্ষিণ ২৪ পরগনার বড় বাজারগুলিতেও। ব্যবসায়ীদের গলায় হতাশার সুর। ক্যানিং, গোসাবা, বাসন্তী, কাকদ্বীপ, ভাঙড়, জয়নগর— সর্বত্রই প্রায় একই পরিস্থতি।
জেলার অন্যতম বড় বাজার ক্যানিং বাজার। মাতলা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই বাজারে মহকুমার সমস্ত ব্লক তো বটেই, উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ, সরবেড়িয়া থেকেও পুজোর কেনাকাটা করতে আসেন মানুষ। কিন্তু এ বার এখনও পর্যন্ত ক্রেতার ভিড় তেমন চোখে পড়ছে না বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা। ক্যানিং মহকুমার একমাত্র শপিং মলও কার্যত ফাঁকা। নানা রকম ‘অফার’ দিয়েও সে ভাবে খরিদ্দার টানা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন মল-কর্মীরা।
ক্যানিংয়ের পোশাক ব্যবসায়ী অজয় সাহা বলেন, “গত বছরের তুলনায় এ বছর ব্যবসায় অনেক বেশি বরাদ্দ করেছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সে ভাবে বিক্রি শুরু হয়নি। প্রতিদিন গড়ে ৩০ হাজার টাকার মতো বেচাকেনা হচ্ছে। অন্যান্য বছর এই সময়ে লক্ষাধিক টাকার বেচাকেনা হত।” একই বক্তব্য ক্যানিং বাজারের জুতো ব্যবসায়ী সুমিত সাহার। তিনি বলেন, “এ বারে ব্যবসার যা অবস্থা, তাতে মহাজনের টাকা শোধ করাই কঠিন হয়ে পড়বে।” ক্যানিং বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক হরিনারায়ণ খাঁড়া বলেন, “ব্যবসায়ীরা সারা বছর ধরে পুজোর জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। কিন্তু এ বছর পুজোর বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ।” বাসন্তী ও গোসাবা বাজারেও ব্যবসার অবস্থা বেশ খারাপ বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।
মৃৎশিল্প, ডেকরেটর্সের ব্যবসাতেও লোকসান চলছে বলে মত এই সব ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত মানুষজনের। বাসন্তীর ডেকরেটর দুলাল সাহা বলেন, “পুজো কমিটিগুলি এ বার বাজেট অনেক কমিয়ে দিয়েছে। ফলে কম পারিশ্রমিকেই প্যান্ডেলের কাজ করতে হচ্ছে। সারা বছরের মধ্যে কর্মীরা এই সময়েই একটু বাড়তি রোজগারের আশায় বসে থাকেন। তাঁদের কী হবে জানি না।” ক্যানিংয়ের প্রতিমা শিল্পী নারায়ণ পাল বলেন, “রং থেকে শুরু করে শ্রমিকদের মজুরি— সবই বেড়েছে। কিন্তু ঠাকুরের দাম বাড়েনি। উল্টে কম দামের ঠাকুর খুঁজছেন পুজো উদ্যোক্তারা। ফলে আমাদের লাভের ভাঁড়ার শূন্যই।”
পুজোর বাজেটে অনেকখানি কাটছাঁট করছেন ক্যানিং মহকুমার পুজো উদ্যোক্তারা। ক্যানিং মিঠাখালি সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটির সম্পাদক পরেশরাম দাস বলেন, “গত বছরের তুলনায় অন্তত ছ’লক্ষ টাকা বাজেট কমানো হয়েছে।” একই পথে হেঁটেছে ক্যানিং হাসপাতাল পাড়া সর্বজনীন পুজো কমিটি। পুজো কমিটির সভাপতি অর্ণব রায় বলেন, “প্যান্ডেল, আলো, ঠাকুর সব ক্ষেত্রেই এ বার আমরা কাটছাঁট করছি। গত বছরের তুলনায় অন্তত পাঁচ লক্ষ টাকা কম বাজেট ধরা হয়েছে।”
ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপের পুজো-বাজারের হালও তথৈবচ। সেখানে অবশ্য কারণটা স্পষ্ট। সমুদ্রে ইলিশের আকাল ধাক্কা দিয়েছে পুজো বাজেটে বলে মত স্থানীয় বাসিন্দাদের। কাকদ্বীপ গঙ্গাধরপুর ইয়ং ফাইটার্স সর্বজনীন পুজো কমিটি জানাল, আগের বারের পুজোর বাজেট ছিল ১২ লক্ষ টাকা। সেটা কমিয়ে ৫-৬ লক্ষে আনা হয়েছে। ওই কমিটির অধিকাংশ সদস্যই কোনও না কোনও ভাবে মাছ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। কারও নিজস্ব ট্রলার আছে। কেউ মাছ ধরতে নিজেই সমুদ্রে যান। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে ট্রলার নিয়ে মাঝসমুদ্রে গিয়ে এ বার খালি হাতে ফিরতে হয়েছে মৎস্যজীবীদের। এ কারণে কাকদ্বীপ জুড়ে ছোট-বড় সমস্ত পুজো কমিটির ভাঁড়ারেই টান পড়েছে।
ইয়ং ফাইটার্সের সদস্য অমল দাস জানান, অনেক পরিবারে নতুন জামাকাপড় কেনার মতো টাকাই হাতে নেই। ফলে গ্রামে কোনও উন্মাদনাও নেই। ধার-দেনা করে পুজোর খরচ চালাতে হবে বলে অনেকেই মুষড়ে পড়েছেন।
একই কথা শুনিয়েছে কাকদ্বীপের অন্যতম সেরা পুজো বর্ণালী সঙ্ঘ। সঙ্ঘের সম্পাদক সতীনাথ পাত্র বলেন, ‘‘ইলিশ না মেলায় হাতে সকলেরই টাকা কম। গত বছর পুজো বাজেট ছিল ১৫ লক্ষ টাকা। এ বার সেটা কমে ১২ লক্ষে এসে দাঁড়িয়েছে।
কাকদ্বীপের ইয়ং স্টাফ পুজো কমিটিরও একই অবস্থা। ওই পুজো কমিটির সম্পাদক দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘গতবারের তুলনায় এ বারের বাজেট কমিয়েছি। তাতেও সামলানো যাচ্ছে না। সম্ভবত দেনা করে পুজো চালাতে হবে।’’
এখনও সে ভাবে জমে ওঠেনি ভাঙড় এবং নিকটবর্তী বিভিন্ন এলাকার পুজোর বাজার। পুজো উদ্যোক্তারা মনে করছেন, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থায় কর্মী ছাঁটাই, বেতন না পাওয়ার কারণে বাজার ধাক্কা খেয়েছে। অনেকেই কেনাকাটা ঠিকমতো করতে পারছেন না। দোকানে চাঁদা চাইতে গেলে তাঁরা হাত তুলে নিচ্ছেন। পাড়ার যে সমস্ত ব্যক্তিরা আগে নিজেরাই উদ্যোগ করে পুজোর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াতেন তাঁরা এ বার মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছেন। প্রতি বারই পুজো মণ্ডপে বিভিন্ন ছোট ছোট সংস্থা তাদের বিজ্ঞাপন দিত। এ বার এ জাতীয় বিজ্ঞাপন অনেকটাই কম এসেছে। পাড়ার পুজো টিকিয়ে রাখতে পুজো কমিটির সদস্যদেরই এ বার নিজেদের গাঁটের কড়ি খরচ করতে হচ্ছে।
ভাঙড়ের কাশীপুরের ‘শতধারা প্রমীলা সঙ্ঘের’ শারদোৎসবের মূল উদ্যোক্তা মহিলারা। তাঁরা জানালেন, এ বার ঠিকমতো চাঁদা উঠছে না। পুজো নিয়ে তাঁরা চিন্তিত। অন্যান্য বারের তুলনায় এ বার প্রতিমার দাম, ঢাকির সম্মানদক্ষিণা, ডেকরেটর্সের খরচ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। ওই পুজো কমিটির সম্পাদক কাকলি পাল বলেন, ‘‘এই এলাকার লোকজন প্রধানত কৃষিজীবী। আর একটি অংশ বিভিন্ন কলকারখানায় কাজ করেন। সবারই সীমিত সামর্থ্য। কেউ সেই ভাবে চাঁদা দিতে পারেন না। এ বার তো একেবারেই পারছেন না।’’
ভাঙড়ের অফিসপাড়ার ‘আমরা সবাই শারদোৎসব কমিটি’র পক্ষে কৌশিক সর্দার বলেন, ‘‘এ বার বাজার খুবই খারাপ। কেউ চাঁদা দিতে চাইছেন না। আমাদের পুজো কমিটির সদস্যেরা বাজারে চাঁদা চাইতে গেলে ব্যবসায়ীরা ফিরিয়ে দিচ্ছেন। সকলেই বলছেন বিক্রিবাট্টা নেই।’’
জয়নগর, দক্ষিণ বারাসতেও পুজোবাজারের অবস্থাও এর থেকে আলাদা কিছু নয়। দক্ষিণ বারাসতের পুরনো এক বস্ত্রবিপণির তরফে সুমিত মজুমদার বলেন, ‘‘পুজোর কুড়ি দিন আগে যে পরিমাণ কেনাকেটা হওয়ার কথা, তা এ বার হচ্ছে না। এ বার চাষ ভাল না হওয়ায় হয় তো মানুষের হাতে টাকা-পয়সা কম রয়েছে।’’
এলাকার অন্যতম বড় ডেকরেটর্সের কর্ণধার স্বপনকুমার মণ্ডল বলেন, ‘‘গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বার বাজার খারাপ। অনেক পুরনো পুজো কমিটির তরফেই কম টাকায় কাজ করার অনুরোধ আসছে। অনেকে আবার বাজেটের জন্য মণ্ডপ ছোট করে দিচ্ছেন।’’
সব মিলিয়ে শিউলিভোরে পুজোর আনন্দে মেতে ওঠার আগে মুখ কিন্তু ভারই আমজনতার। মুখ শুকনো পুজো কমিটিরও।
তথ্য সহায়তা: দিলীপ নস্কর, সামসুল হুদা, সমীরণ দাস, প্রসেনজিৎ সাহা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy