কেদার সর্দার
কয়েক বছর আগেও খড়ের চালের ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে কলাগাছি নদীতে মাছ ধরতে দেখা যেত ছোটখাট গোলগাল চেহারার যুবককে। ক্রমে ক্রমে শ্রীবৃদ্ধি হয় তার। তবে সেটা যে গুটিকয় মাছ ধরে বিক্রির করার টাকায় নয়, তা বিলক্ষণ জানেন সন্দেশখালির খুলনার পোলপাড়ার মানুষ। কারণ ইদানীং তোলাবাজি, মারধর, হামলার ঘটনায় হাত পাকিয়েছে বছর পঁয়ত্রিশের কেদার সর্দার। নানা সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে দহরম মহরম তার। গ্রামের লোক এখন আর ঘাঁটাতে সাহস পান না কেদারকে। বরং তার ভয়েই থরহরিকম্প এলাকা।
গত পঞ্চায়েত ভোটে স্ত্রী শিবানীকে তৃণমূলের টিকিটে জিতিয়ে আনার পিছনে কারিগর সেই কেদারই। তার দাপটে বিরোধীরা এলাকায় প্রার্থীই দিতে পারেনি বলে অভিযোগ ওঠে। ভিলেজ পুলিশকে গুলি করে খুনের অভিযোগে কেদার ও তার সাগরেদ লাল্টু সর্দারকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। শুক্রবার রাতে পুলিশের উপরে হামলার পরে কেদারের বাড়িতে ভাঙচুর চালায় গ্রামের লোকজন। গুলি চালানোর ঘটনায় ধৃত লাল্টু সর্দারের বাড়িতেও ভাঙচুর চালায় জনতা।
কলাগাছি নদীর পাড়ে কেদার সর্দারের ঠেক। ইটের গাঁথনির উপরে অ্যাসবেস্টসের চাল দেওয়া ঘর। টিভি, ফ্রিজ, খাট, আলমারি দিয়ে সাজানো। সেখানে মদ-গাঁজার আসর বসে দিনরাত, জানালেন গ্রামের লোক। কিন্তু মুখ খোলার সাহস নেই কারও। আকণ্ঠ মদ্যপান করে কেদার কখন যে কার উপরে হামলা চালাবে, তা বোঝা মুশকিল।
এই তো ক’দিন আগের কথা। ভান্ডারখালি বাজারের এক ব্যবসায়ী ও চিকিৎসকের কাছ থেকে টাকা চেয়েছিল কেদার। টাকা দিতে অস্বীকার করায় মারধরের অভিযোগ কেদার-বাহিনীর বিরুদ্ধে। গ্রামের লোক এককাট্টা হয়ে রুখে দাঁড়ালে দুষ্কৃতীরা বোমা-গুলি ছোড়ে। প্রতিবাদে বাজার বন্ধ রেখেছিলেন ব্যবসায়ীরা। তারপরেও অবশ্য গ্রেফতার হয়নি যুবক। এলাকায় কান পাতলে শোনা যায়, শাসক দলের কোনও কোনও নেতার হাত তার মাথায়। কেদারের টিকি ছোঁবে কে! বিজেপির জেলা সভাপতি গণেশ ঘোষ বলেন, ‘‘তৃণমূলই দুষ্কৃতীদের পুষছে। এলাকায় সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করেছে।’’ খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক আবার কেদারকে বিজেপি ঘনিষ্ঠ বলেই দাবি করেছেন। গ্রামের মানুষের বক্তব্য, ‘‘যখন যে ক্ষমতায়, কেদার তারই লোক হয়ে ওঠে অনায়াসে। তার মতো দুষ্কৃতীদের সময় বিশেষে মদত দেয় সব দল।’’
নদীপথে সুন্দরবন দিয়ে বাংলাদেশে গরুপাচারেও কেদার জড়িত বলে গ্রামের মানুষের অভিযোগ। কিন্তু এ নিয়ে থানা-পুলিশ করবে, এ সাহস এত দিন কারও ছিল না। সঙ্গে সব সময়ে রিভলভার নিয়ে ঘোরে সে, এমনটাই দাবি গ্রামের কারও কারও।
সন্দেশখালির এই এলাকার ভৌগোলিক অবস্থাও কেদারের মতো দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্তের একটা কারণ বলে মনে করেন গ্রামের মানুষ। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে থানা। কিন্তু সেখানে যেতে হলে পেরোতে হয় কলাগাছি নদী। নদীর এক পাড়ে কেদারের রাজত্বে গোলমালের খবর পেয়ে পুলিশ আসতে আসতেই ভেগে পড়ে সে।
রজনী চৌকিদারের খেয়াঘাটের পাশেই কেদারের বাড়ি। বাবা চাঁদ সর্দার চলাফেরা করতে পারেন না। মা উর্মিলা বলেন, ‘‘নদীতে মাছ ধরে অনেক কষ্ট করে তবেই একটু দাঁড়াতে পেরেছে কেদার। বৌমা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য। এ সব দেখে কিছু লোকের গায়ে জ্বালা ধরে। তারাই আমার ছেলের নামে খারাপ কথা রটায়।’’ উর্মিলার বক্তব্য, ‘‘ওর বিরুদ্ধে পুলিশকে গুলি করার যে অভিযোগ উঠছে, সেটাও মিথ্যা। বরং সুযোগ বুঝে বিরোধীরাই আমাদের বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর, লুটপাট করে গেল।’’ মায়ের সরল প্রশ্ন, ‘‘আমার ছেলে যদি এতই খারাপ হবে, তা হলে বৌমাকে লোকে ভোট দিয়ে জেতাল কেন!’’
বিরোধীরা অবশ্য বলছেন, কেদার-বাহিনী অন্য কাউকে ভোটে দাঁড়াতে দিলে তো!
মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে খুলনা হাসপাতালের বেডে শুয়েছিলেন সাইফুল শেখ। বললেন, ‘‘কেদার, আমি— সকলেই তৃণমূল করি। কিন্তু ওর দলবলের উপদ্রবে মানুষ অতিষ্ঠ।’’ সাইফুল জানান, পুজোর সময়ে এক তরুণীর শ্লীলতাহানি করে কেদার। তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন সাইফুল-সহ কয়েক জন। শুক্রবার গ্রামে জলসার ভিড়ে তাঁদের দেখতে পেয়ে গুলি-বোমা ছোড়ে কেদাররা। ছুরি চালায় এক জনের পেটে। গ্রামের এক যুবকের কথায়, ‘‘মাথা গরম লোক কেদার। আর মদ পেটে পড়লে কথাই নেই। যাকে তাকে মারধর করতে পারে ও!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy