মাতলার বুকে চর। নিজস্ব চিত্র Sourced by the ABP
এক সময়ে নদী এতটাই উত্তাল ছিল, নাম দেওয়া হয় ‘মাতলা’। কলকাতা বন্দরে হুগলি নদী নাব্যতা হারাতে পারে বলে ব্রিটিশরা ক্যানিংয়ে বিকল্প বন্দর তৈরি করেছিলেন এই মাতলা নদীকে কেন্দ্র করে। সে কারণেই ভারতের দ্বিতীয় রেলপথ হিসেবে শিয়ালদহ থেকে ক্যানিং লাইন পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়েছিল। বর্তমানে সেই মাতলা তার গতি হারিয়েছে। এখন কার্যত মৃতপ্রায়।
স্থানীয় সূত্রের খবর, কয়েক বছর আগেও মাতলায় নৌকো বা ভুটভুটিতে যাত্রী পারাপার হত। এখন নদীর উপরে সেতু নির্মাণ হওয়ায় তা বন্ধ রয়েছে। অন্য দিকে, ক্যানিং ও বাসন্তী ব্লক বিভাজনকারী এই মাতলার বুকে বিশাল চর দেখা দিয়েছে। প্রতিনিয়ত সেখানে পলি জমে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে নদীর গতিপথ। বর্তমানে নদীর জলধারণ ক্ষমতা বা নাব্যতা তলানিতে ঠেকেছে। এতেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে নদী বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবিদদের।
স্থানীয় মানুষ জানাচ্ছেন, আগে এই মাতলা নদীর ব্যাপ্তি ছিল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে। বর্তমান ক্যানিং বাজার-সহ আশপাশের সমস্ত এলাকাই ছিল মাতলার দখলে। ধীরে ধীরে পলি জমে সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে মাতলা। সেই জায়গায় ক্রমেই বসতি, দোকানপাট, বাজার গড়ে ওঠে। বর্তমানে ক্যানিং মহকুমাশাসকের দফতর থেকে শুরু করে বিডিও অফিস ও অন্যান্য সরকারি দফতর গড়ে উঠেছে মাতলার চরে। বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে মাতলার যে মূল অংশ দিয়ে নৌকো, লঞ্চ চলত, বর্তমানে সেই অংশও মজতে বসেছে। গত কয়েক বছরে নদীর মাঝখানেই পলি জমে দ্বীপ দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষিতীশ বিশাল স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন। তিনি বলেন, ‘‘আমরা ছোটবেলায় এই মাতলার ভয়ঙ্কর রূপ দেখেছি। এখন মাতলা মজে গিয়েছে। যে নালায় নিয়মিত জোয়ার-ভাটা খেলত, সেটিও মজে যাচ্ছে। মাতলার বুকে দুটো সেতুর স্তম্ভ নির্মাণের ফলেই এই এলাকায় দ্রুত পলি জমে চর তৈরি হয়েছে।”
নদী এ ভাবে মজে গিয়ে জলধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় নানা ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। বিশেষ করে ভরা কটাল বা বড়সড় কোনও ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবনের বুকে আছড়ে পড়লে নদীবাঁধ ভেঙে বা উপচে নোনা জল ঢুকে পড়ছে এলাকায়। বর্ষাকালেও এলাকা প্লাবিত হওয়ার ঘটনাও বাড়ছে। পরিবেশবিদ সুভাষ দত্ত বলেন, “আমরা প্রকৃতির সঙ্গে চরম অন্যায় করছি। নদীতে বাঁধ দিয়ে তার গতিপথ আটকে দেওয়া হচ্ছে মাছের ভেড়ি করার জন্য। নদীর চর দখল করে কোথাও বা নদীবক্ষেই কংক্রিটের নির্মাণ তৈরি হচ্ছে। দিনের পর দিন এ সব হতে থাকলে প্রকৃতি তো প্রতিশোধ নেবেই।”
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, সুন্দরবন এলাকায় প্রতি বছর ৩ থেকে ৭ মিলিমিটার পর্যন্ত জলস্তর বাড়ছে। এই পরিমাপ দেশের অন্যান্য উপকূলের তুলনায় অনেকটা বেশি। এর ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সমুদ্রের জল স্থলভাগের অনেকটা ভিতরে ঢুকে পড়ছে। আয়লা, ইয়াস ও আমপানের মতো ঝড়ের সময়ে যে ভাবে নদী বা সমুদ্রের জল স্থলভাগে ঢুকে পড়েছিল, তাতে এই তথ্যের সত্যতা মানছেন সকলেই।
প্রায় একই মত দীর্ঘ দিন ধরে সুন্দরবন এলাকার জলবায়ু, মাটি নিয়ে কাজ করা কেন্দ্রীয় লবণাক্ত মৃত্তিকা গবেষণা সংস্থার প্রধান বিজ্ঞানী উত্তমকুমার মণ্ডলের। তিনি বলেন, “ইংল্যান্ডের লিভারপুলে ‘পার্মানেন্ট সার্ভিস ফর মিন সি লেভেল’ নামে একটি সংস্থা দীর্ঘ দিন ধরে সমুদ্রের জলস্তরের তথ্য সংগ্রহ করছে। সেই রেকর্ডে দেখা গিয়েছে, মুম্বই, কোচি বা বিশাখাপত্তনম উপকূলে বছরে যে পরিমাণ জলস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, সুন্দরবনে ও সংলগ্ন এলাকায় সেই পরিমাণ তুলনায় বেশি। এর অন্যতম কারণ, নদীতে চরা পড়া, নাব্যতা কমে যাওয়া।”
নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের কথায়, “মাতলার মতো নদীগুলি যে পরিমাণ পলি জোয়ারের সময়ে নিয়ে ঢোকে, ভাটার সময়ে সেই পরিমাণ পলি নিয়ে বের হতে পারে না। সেই পলি জমেই এই দ্বীপগুলি তৈরি হচ্ছে। মাতলা নদী তার নাব্যতা হারাবে, তা অনেক আগেই বোঝা গিয়েছিল। সে কারণেই এখানে বন্দর তৈরি হলেও তা দশ বছরের বেশি টেঁকেনি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy