এ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে ইতিমধ্যেই প্রার্থী দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (মিম) প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি।
আসন্ন বিধানসভা ভোটে সংখ্যালঘু ভোট নিজেদের দিকে টানতে উঠেপড়ে লেগেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কিছু ধর্মীয় সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে চাইছে কেউ কেউ। অভিযোগ, সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগি করতে বিজেপি ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির আহলে সুন্নাতুল জামাত, আসাদউদ্দিন ওয়েইসির অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিনকে কাজে লাগাচ্ছে। পিছিয়ে নেই বাম, কংগ্রেস, তৃণমূলও। ইতিমধ্যে আব্বাস সিদ্দিকিকে নিজেদের দিকে টানতে কংগ্রেসের দুই বর্ষীয়ান নেতা ফুরফুরা শরিফে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন। তৃণমূলও সংখ্যালঘু ভোট ধরে রাখতে ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা ত্বহা সিদ্দিকিকে মাঠে নামিয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত। এরই মধ্যে উঠে আসছে মিমের নাম। বিহার ভোটে মিমের উত্থান বিজেপিকেই সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মত। এ রাজ্যে ভোটের অঙ্কে মিমের ভূমিকা কী হতে চলেছে, তাই নিয়েও শুরু হয়েছে জল্পনা।
এ রাজ্যে তৃণমূলের উত্থানের শুরু থেকেই সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কের একটা বড় অংশকে তারা পাশে পেয়েছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা কার্যত একমত। কিন্তু আসন্ন বিধানসভা ভোটে সেই শক্ত ভোটব্যাঙ্কে ফাটল ধরলে বহু হিসেব উলোটপালট হয়ে যেতে পারে বলে তৃণমূল শিবিরের একাংশের মধ্যেও আশঙ্কা আছে।
এ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে ইতিমধ্যেই প্রার্থী দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (মিম) প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েইসি। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর-সহ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রায় ৪০টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে তারা। সংগঠন সূত্রের খবর, দুই ২৪ পরগনার ১০-১২টি আসনে প্রার্থী দিতে পারে তারা।
বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির অভিযোগ, মিমের সঙ্গে বিজেপির গোপন আঁতাত রয়েছে। সংখ্যালঘুদের ভোট কাটাকুটি করে তারা আদতে বিজেপিকে রাজনৈতিক ফায়দা দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। সে কথা অবশ্য মানে না মিম বা বিজেপি-কোনও পক্ষই। তবে সাম্প্রতিক কয়েকটি ভোটে দেখা যাচ্ছে, মিমের শক্তিবৃদ্ধিতে লাভ হয়েছে পদ্ম শিবিরেরই।
বিজেপির অন্দরের খবর, রাজ্যে ১৮টি লোকসভা আসনে জয়ের নিরিখে গেরুয়া শিবির বিধানসভা নির্বাচনে ১২০টি আসনে এগিয়ে ছিল। এই পরিস্থিতিতে আরও ৩০-৪০টি আসন সংখ্যালঘু ভোট কাটাকাটির ফলে যদি বিজেপির ঝুলিতে চলে আসে, তা হলে বিজেপির বঙ্গবিজয় অনেক সহজ হয়ে যাবে।
গত বিধানসভা ভোটে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ৩১টি আসনের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছিল ২৯টি আসন এবং বামেরা পেয়েছিল ২টি আসন। লোকসভা নির্বাচনে জেলার চারটি আসনেই জয়লাভ করেছিল তৃণমূল। তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, এ বার জেলায় সব ক’টি আসন ধরে রাখার ক্ষেত্রে সংশয় আছে দলেরই অন্দরে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৮১ লক্ষ জনসংখ্যার প্রায় ৩৫ শতাংশ সংখ্যালঘু। ভাঙড়, ক্যানিং পূর্ব, মগরাহাট পূর্ব, পশ্চিম, বারুইপুর পূর্ব, পশ্চিম, ফলতা, বজবজ, ডায়মন্ড হারবার, কুলপিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাল ভোটব্যাঙ্ক রয়েছে। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, ওই ৩৫ শতাংশ ভোট যদি শাসকদলের ঝুলিতে না গিয়ে ভাগ হয়ে যায়, তা হলে জেলার ৩১টি আসনের মধ্যে বিজেপির দখলে চলে যেতে পারে ১০-১২ টি আসন।
ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা আহলে সুন্নাতুল জামাতের কর্ণধার আব্বাস সিদ্দিকিও প্রার্থী দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। যদিও আব্বাস সিদ্দিকি ও আসাদউদ্দিন ওয়েইসি আসন সমঝোতা করবেন কিনা, তা এখনও নিশ্চিত নয়। তৃণমূলও মনে করছে, সংখ্যালঘু ভোট ভাগাভাগি হলে বেশ কিছু আসনে তার প্রভাব পড়বে। সেই কারণে রাজ্যের শাসক দল সংখ্যালঘু ভোট ধরে রাখতে ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা ত্বহা সিদ্দিকিকে মাঠে নামিয়েছে। তৃণমূলের অভিযোগ, শাসকদলের ভোটব্যাঙ্ক ভাঙতে এবং বিজেপিকে সহযোগিতা করতে মিম ও আব্বাস সিদ্দিকিকে সিপিএম, কংগ্রেসও মদত দিচ্ছে।
এ বিষয়ে মিমের রাজ্য কমিটির সদস্য তথা মেটিয়াবুরুজের ব্লক সভাপতি মহম্মদ কারিব মোল্লা বলেন, ‘‘ওয়েইসি সাহেবের নির্দেশে রাজ্যে আমরা প্রায় ৪০টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যাঁরা বলছেন বিজেপিকে জেতাতে আমরা প্রার্থী দিচ্ছি, তাঁরা ভুল বলছেন। আসাদউদ্দিন ওয়েইসি, ইমতিয়াজ দোলুই শুধু মুসলিম ভোটে জেতেননি। বিজেপিকে হারাতে আমরা বদ্ধপরিকর। বিজেপি এবং তৃণমূল আরএসএসের সঙ্গী। তৃণমূলের হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ১৮টি আসন পেয়েছে। বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে আমরা জোট করতে চেয়েছিলাম। যদি কেউ আমাদের সঙ্গে জোট না করে, তা হলে আমরা সংখ্যালঘু, দলিত, আদিবাসীদের জন্য একাই ভোটে লড়ব।’’
আহলে সুন্নাতুল জামাতের ভাঙড় ১ ব্লকের সভাপতি শরিফুল মোল্লা বলেন, ‘‘বিজেপিকে হারাতে বৃহত্তর জোট তৈরির চেষ্টা করার পরিকল্পনা নিয়েছেন আমাদের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। যাঁরা বলছেন সংখ্যালঘু ভোট কাটাকাটি করে আমরা বিজেপিকে জেতাতে চাইছি, তাঁরা ভুল বলছেন। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এ রাজ্যে ১৮টি আসন পেয়েছিল। তখন তো আহলে সুন্নাতুল জামাত ভোটের ময়দানে নামেনি। তা হলে বিজেপি এ রাজ্যে কী ভাবে অতগুলো আসন পেল? তৃণমূলের হাত ধরেই এ রাজ্যে বিজেপি আসছে।’’
এ বিষয়ে ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক তথা জেলার যুব তৃণমূল সভাপতি শওকত মোল্লা বলেন, ‘‘অতীতে বিভিন্ন ধর্মীয় রাজনৈতিক দল ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে রাজনীতি করতে চেয়েছিল। তারা সে ভাবে সুবিধা করতে পারেনি। তৃণমূলের ভোটব্যাঙ্ক ভাঙতে বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল ধর্মের ভিত্তিতে ভোট ভাগ করতে চাইছে। তারা সুবিধা করতে পারবে না।’’
কংগ্রেসের জেলা সভাপতি জয়ন্ত দাস বলেন, ‘‘বিজেপির হাতে তামাক খেয়ে মিম তাদের জেতাতে সহযোগিতা করবে। তবে ওদের তেমন সংগঠন নেই। এক সময়ে মুসলিম লিগ, হিন্দু মহাসভা রাজ্য রাজনীতিতে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। মিমও কিছু সুবিধা করতে পারবে না। কংগ্রেস একটি বৃহৎ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল। আমরা চাইব, বিজেপি বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দল আমাদের ছাতার তলায় আসুন। বিজেপি বা মিম যত মাথা ছাড়া দেবে, ততই ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি সঙ্ঘবদ্ধ হবে।’’
বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘বিজেপি সব রকম ভাবে চেষ্টা করবে, বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগাভাগি করে দিতে। আমরা চেষ্টা করব, বিজেপিকে হারানো নিশ্চিত করতে বিজেপি বিরোধী ভোট এক জায়গায় নিয়ে আসতে।’’
এ বিষয়ে বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য অভিজিৎ দাস (ববি) বলেন, ‘‘মিমের কারণে বিহারে আমরা জিতেছি, এটা ভুল ধারণা। অনেক সংখ্যালঘু মানুষ আমাদের সমর্থন করছেন। মিম প্রার্থী দিলে বিজেপির সুবিধা হবে, এটা ভাবাও ভুল। বরং মিম যে ভোট পাবে, তা তৃণমূল বিরোধী। মিম না থাকলে তৃণমূল বিরোধী ভোট বিজেপি পেত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy