হেস্তনেস্ত: কার্ড করাতেই হবে, লাইন ডাকঘরের সামনে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
রাত ১টা। বনগাঁ শহরে মুখ্য ডাকঘরের গেট বন্ধ। ওই বন্ধ গেটের সামনে রাস্তার পাশে পলিথিনের উপরে কাঁথা পেতে বসে এক মহিলা। গায়ে একখানা চাদর। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছিলেন। ঠান্ডার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জোরে বাতাস বইতে শুরু করেছে তখন।
শীতের রাতে তিনিই একাই কেবল নন, তাঁর মতো অনেক মহিলা-পুরুষ প্রতি দিনই মুখ্য ডাকঘরের সামনে রাস্তায় রাত জাগছেন। সঙ্গে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও থাকছে। সকলেই নতুন আধার কার্ডের আবেদন করা বা আধার কার্ডে থাকা ভুল তথ্য সংশোধন করাতে এসেছেন। সকালে ডাকঘর খুললে যাতে কাজ তাড়াতাড়া হয়, তাই রাত জাগছেন রাস্তায়। ডাকঘর কর্তৃপক্ষ প্রতি দিন ৩০-৩৫টির বেশি আবেদন জমা নিচ্ছেন না। ফলে সকালে এসে আবেদন জমা করতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন অনেকে। বাধ্য হয়েই তাঁদের রাত কাটছে রাস্তায়।
সকলেরই দাবি, ডাকঘর কর্তৃপক্ষ যদি আবেদন জমা নেওয়ার সংখ্যা বাড়াতেন, তা হলে এই দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হত না।
সোমবার রাত ১টা নাগাদ বনগাঁ মুখ্য ডাকঘর এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, বন্ধ গেটের বাইরে, বন্ধ দোকানের সামনে, রাস্তার উপরে পলিথিন, চট পেতে চাদর মুড়ি দিয়ে কেউ ঘুমিয়ে আছেন। কেউ শিশু কোলে নিয়ে বসে। কেউ এসেছেন অসুস্থ অবস্থায়। শীতে জবুথবু অবস্থা। পাশ দিয়ে রাস্তায় কুকুরের দল ঘোরাঘুরি করছে। তাতে লোকজন ভয়ে আরও কুঁকড়ে গিয়েছেন। দু’একজন মদ্যপকেও ঘুরতে দেখা গেল।
বাগদার বয়রা পঞ্চায়েতের কুলনন্দপুর গ্রাম থেকে এসেছিলেন সুপ্রিয়া বিশ্বাস। চার বছরের ছেলে নুর আলমকে নিয়ে রাস্তায় বসেছিলেন। ছেলের নতুন আধার কার্ড এবং নিজের আধার কার্ডে নামের ভুল সংশোধন করাবেন বলে এসেছেন। সোমবার সকাল ১০টার সময়ে এসেছিলেন। আবেদন জমা দিতে পারেননি বলে বাড়ি ফিরে যান। ছেলেকে নিয়ে সারা রাত বসেছিলেন মঙ্গলবার আবেদন জমা দিয়ে ফিরবেন বলে। সুপ্রিয়া বললেন, ‘‘সকালে বাড়ি থেকে খেয়ে বেরিয়েছিলাম। রাতে হোটেলে খেয়েছি। চলে গেলে আর লাইন পেতাম না।’’ বনগাঁ শহরের রেলবাজার এলাকার বাসিন্দা দীপালি প্রামাণিক তিন দিন ধরে ডাকঘরে এসে ঘুরে গিয়েছেন। আবেদন জমা দিতে পারেননি। তাঁর শিশুকন্যা বীণার আধার কার্ড করাবেন। রবিবার ভোর রাত থেকে তিনি ঠায় অপেক্ষা করছিলেন ডাকঘরের সামনে। কালুপুর জিয়ালা ধর্মপুর থেকে এসেছিলেন সন্তোষী অধিকারী। দেড় বছরের নাতনি ঈশাকে নিয়ে রাত জাগছিলেন। ঈশার নতুন আধার কার্ড তৈরি করাবেন। সোমবার দুপুর থেকে অপেক্ষা করছিলেন। বনগাঁ শহরের এক ব্যক্তি মোবাইলে আধার লিঙ্ক করাতে পারেননি বলে বেতন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তাঁর ছেলে বাবার হয়ে রাত জাগছিলেন। অভিযোগ, আবেদন জমা দিতে গিয়েও মানুষকে নানা ভাবে হয়রানি করছেন ডাকঘর কর্তৃপক্ষ।
এ দিন রাতে অপেক্ষা করা মানুষেরা জানালেন, ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে হলে আধার কার্ড চাওয়া হচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে গেলে চাওয়া হচ্ছে। ব্যাঙ্কে পাসবই করতে হলে চাওয়া হচ্ছে।
এর মধ্যে এনআরসি ও সিএএ নিয়েও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অনেকেরই ধারণা, আধার কার্ড ঠিক না থাকলে এ দেশের নাগরিক হতে পারবেন না। তাই কষ্ট করে হলেও লাইন রেখেছেন। রাত জাগা মানুষদের আরও একটি সমস্যা তৈরি হয়েছে। তাঁদের কথায়, ‘‘আমরা রাত জেগে লাইন দিচ্ছি। সকালে স্থানীয় লোকজন এসে আমাদের জোর করে সরিয়ে দিচ্ছে। যা নিয়ে গোলমাল, ধাক্কাধাক্কি হচ্ছে।’’ ডাকঘর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, নতুন আধার কার্ড তৈরি বা ভুল সংশোধন করবার জন্য দু’টি কাউন্টার খুলে ফর্ম জমা নেওয়া হচ্ছে। বিকেল ৪টের পরে সার্ভার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কর্মী সংখ্যা কম। সে কারণে ৪০-৪৫টির বেশি আবেদন একদিনে জমা নেওয়া যাচ্ছে না। পোস্টমাস্টার মনোরঞ্জন মাইতি বলেন, ‘‘ডাকঘরের অন্য শাখা থেকে কর্মী তুলে এনে আধারের কাজ করানো হচ্ছে। আলাদা করে কোনও কর্মী দেওয়া হয়নি। কর্মী সংখ্যা বাড়ানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। পাওয়া গেলে সমস্যা অনেকটা মিটবে। ডাকঘর চত্বরে সরকারি গাড়ি থাকে। নিরাপত্তার কারণে রাতে গেট খুলে রাখতে পারি না।’’
তৃণমূলের তরফে মানুষকে হয়রানির প্রতিবাদে শহরে মিছিল করা ও স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল। পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্য বলেন, ‘‘আগে দিনে ১০টি করে আবেদন জমা নেওয়া হচ্ছিল। এখন কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু মানুষের দুর্দশা কমেনি। পুরসভার থেকে কর্মী দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ডাকঘর কর্তৃপক্ষ নেননি। এটা নিয়ে ফের পথে নামা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy