কচ্ছপ উদ্ধার করতে জামালের বাড়ির সামনে বন দফতরের কর্মীরা। দরজা বন্ধ থাকায় ফিরে যান তাঁরা। বুধবার রাতে। — নিজস্ব চিত্র।
জোর করে বেঁধে রেখে মারধর বা জমি দখল করাতেই আটকে নেই সোনারপুরের প্রতাপনগর পঞ্চায়েতের ‘ত্রাস’ জামাল সর্দারের কর্মকাণ্ড। সন্দেশখালির শেখ শাহজাহানের মতোই প্রতাপনগরের জামালের একের পর এক কুকীর্তি সামনে আসছে। অভিযোগ, পারিবারিক গোলমালের জেরে নিজের মা-দাদাদের উপরেও অ্যাসিড-হামলা চালিয়েছিল জামাল। সে এক বার বন্দুক হাতে পঞ্চায়েত দফতরে ঢুকে খোদ পঞ্চায়েত প্রধানের উপরে চড়াও হয়েছিল বলেও অভিযোগ। এক পঞ্চায়েত সদস্যকে লক্ষ্য করে বোমাবাজির অভিযোগও উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। এমনকি, খুনের মামলাতেও নাম জড়িয়েছিল জামালের।
সম্প্রতি জামালের বিরুদ্ধে সালিশি সভা বসিয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে মারধরের অভিযোগ করেন এলাকারই এক মহিলা। সেই ঘটনায় হইচই পড়ে যায়। পরে আরও এক মহিলা জানান, তাঁর স্বামীকে দোষী সাব্যস্ত করার পরে উল্টো করে বেঁধে মারধর করেছিল জামাল। অভিযোগ, গ্রামে শেষ কথা সে-ই বলত। যে কোনও সমস্যায় তার বাড়ির বাহিরমহলে সালিশি সভা বসত। সেখানে বিচার করত জামাল। সাঙ্গুর গ্রামে তার প্রাসাদোপম বাড়িও ছিল চর্চার বিষয়।
বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত অবশ্য জামালকে ধরতে পারেনি পুলিশ। এ দিনও ভিতর থেকে তালাবন্ধ ছিল তার বাড়ি। জামালের পোষা কচ্ছপ উদ্ধারে দফায় দফায় বাড়িতে আসেন বন দফতরের কর্মীরা। তবে, তালাবন্ধ থাকায় ফিরে যান তাঁরা। জামালের বিভিন্ন কীর্তি সামনে আসার পরে তার বিরুদ্ধে জোর করে জমি দখলের অভিযোগ তুলেছেন এলাকার বহু মানুষ। অভিযোগ, দলবল নিয়ে বেআইনি ভাবে জমি দখল করত জামাল। ওই ভাবেই ফুলেফেঁপে ওঠে সে।
জামালের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে, দক্ষিণ সাঙ্গুরের বাসিন্দা গৌতম বৈদ্য নামে এক ব্যক্তির অভিযোগ, “কয়েক বছর আগে আমার নয় শতক জমির দলিল জাল করে অন্য কারও নামে করে নেওয়া হয়েছিল। থানায় অভিযোগ জানিয়েছি। এলাকায় একটি দুষ্টচক্র কাজ করছে। এখন মনে হচ্ছে, জামালও এর মধ্যে আছে। প্রশাসন বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিক।”
প্রশাসনিক দফতরে যাতায়াত, পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ— এ সবের মাধ্যমেই এলাকায় নিজের আলাদা প্রতিপত্তি তৈরি করেছিল জামাল। কয়েক বছর আগে বন্দুক হাতে পঞ্চায়েত দফতরে ঢুকে প্রধানের উপরে সে হামলা চালায় বলেও অভিযোগ। সেই সময়ে প্রতাপনগর পঞ্চায়েতের প্রধান ছিলেন তাপসী মণ্ডল। তাপসীর ছেলে সাধন মণ্ডলের দাবি, “মা প্রধান থাকায় এলাকায় বেআইনি কাজে সুবিধা করতে পারছিল না জামাল। সেই কারণে ভয় দেখাতে বন্দুক নিয়ে পঞ্চায়েত দফতরে ঢুকে মায়ের উপরে হামলার চেষ্টা করে। আশপাশের লোকজন চলে আসায় পালিয়ে যায়। ঘটনাটি মা পুলিশকেও জানিয়েছিল। তবে, পুলিশ তেমন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।”
জামালের বড় ভাইয়ের স্ত্রী সাহিনা সর্দারের অভিযোগ, “কয়েক বছর আগে অ্যাসিড নিয়ে আমার স্বামীর উপরে হামলা করেছিল জামাল। স্বামীর চোখে অ্যাসিড লাগে। পরবর্তী কালে চিকিৎসা করিয়ে চোখ ঠিক হয়েছে। শাশুড়ি-সহ আরও কয়েক জন ছিলেন। তাঁরাও অ্যাসিডে আহত হন।” স্থানীয় বিজেপি নেতা সমীর নস্করের অভিযোগ, “চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, রাহাজানি— এমন কোনও কাজ নেই, যা জামাল করেনি। অনেক বছর আগে এক বার সাইকেল চুরি করতে গিয়েও ধরা পড়েছিল। আমি পঞ্চায়েত সদস্য থাকাকালীন আমার উপরে বোমা মেরে পালিয়ে যায়। এলাকার ব্যবসায়ীদের ভয় দেখিয়ে টাকা তোলে। ম্যাজিস্ট্রেটের সই, স্ট্যাম্প জাল করার অভিযোগও আছে ওর বিরুদ্ধে।”
২০২১ সালে ওই এলাকার বাসিন্দা হারান অধিকারীকে খুনের মামলাতেও নাম জড়িয়েছিল জামালের। সেই মামলার তদন্তভার নেয় সিবিআই। সেই সময়ে সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতারও হয়েছিল জামাল। পরে জামিনে ছাড়া পায়। অভিযোগ, সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হলেও স্থানীয় পুলিশ কখনওই তার টিকি ছুঁতে পারেনি। একাধিক অভিযোগ দায়ের হলেও কার্যত কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশেই জামাল বার বার পার পেয়ে যেত বলে অভিযোগ। সম্প্রতি মারধরের অভিযোগ দায়ের করা মহিলার ক্ষেত্রেও পুলিশ প্রাথমিক ভাবে চুপ ছিল। পরে সংবাদমাধ্যমে হইচই হতে নড়েচড়ে বসে তারা।
সোনারপুর থানার পুলিশ জানিয়েছে, জামালের খোঁজে তল্লাশি চলছে। মোবাইল ফোনের টাওয়ারের অবস্থানের সূত্র ধরে বুধবার ভাঙড়ে তাকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল। তার পর থেকে আর খোঁজ মিলছে না। জামালের বিরুদ্ধে পুরনো অভিযোগ কিছু থাকলে তা-ও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy