পরীক্ষা শেষে স্বস্তির হাসি অভিভাবকদের। বনগাঁয় ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
অনেকেই বলেন, ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা মানে যেন বাবা-মায়েদেরও পরীক্ষা! জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা বা মাধ্যমিকের ক্ষেত্রে সে কথার ধার-ভার আরও বাড়ে। বৃহস্পতিবার নানা কেন্দ্রে ঘুরে চোখে পড়ল অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার নানা চিত্র।
দুই ২৪ পরগনায় এ বছর মাধ্যমিক দিচ্ছে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার পরীক্ষার্থী। বৃহস্পতিবার মাধ্যমিকের প্রথম দিন অভিভাবকদের অনেকে অফিস ছুটি নিয়ে ছেলেমেয়েদের আনলেন পরীক্ষা কেন্দ্রে। পড়ুয়ারা অনেকেই জানায়, গত ক’দিন রাত জেগে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিয়েছে। বাবা-মায়েদের চোখের নীচের কালি জানান দিচ্ছিল, রাত জেগেছেন তাঁরাও। বিমল চক্রবর্তী নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘ মেয়ের সঙ্গে গত কয়েক রাত আমিও কার্যত জেগে কাটিয়েছি। তাতে মেয়ে একটু উৎসাহ পেয়েছে।’’
এ দিন বনগাঁয় পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণ পরে এক মহিলা ঘামতে শুরু করেন। আশপাশের অনেকে তাঁর চোখেমুখে, মাথায় জল ঢেলে দেন। একটু ধাতস্থ হয়ে মহিলা পরে বললেন, ‘‘বেশি উদ্বেগ হলে এ রকম ঘামি। এখন নিজেকে সামলে নিয়েছি। মেয়েটার পরীক্ষাটা নিয়ে খুবই চিন্তায় আছি।’’ এক পড়ুয়ার বাবাকে দেখা গেল, উত্তেজনায় ঘন ঘন সিগারেটে টান দিচ্ছেন। বললেন, ‘‘এমনিতে খুব একটা সিগারেট খাই না। তবে ছেলেটা ভিতরে বসে লিখতে পারছে কি না, সেটা ভেবে একটু টেনশন হচ্ছে। নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না।’’
শ্যামপদ বিশ্বাস নামে এক ব্যক্তি তার দশম শ্রেণির পড়ুয়া মেয়েকে নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে এসেছিলেন। জানালেন, মেয়ে আগামী বছর মাধ্যমিক দেবে। অন্য স্কুলে কী রকম ভাবে পড়ুয়ারা পরীক্ষা দিতে আসছে— তা দেখাতে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছেন। শ্যামপদের কথায়, ‘‘সব দেখেশুনে আমার তো এখন থেকেই টেনশন হচ্ছে!’’
বনগাঁ শহরের বাসিন্দা অর্পিতা দাসের ছেলে এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। সিট পড়েছে শক্তিগড় হাইস্কুলে। বৃহস্পতিবার ছেলেকে পরীক্ষা কেন্দ্রে ঢুকিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। স্বামী পুলিশে কর্মরত। তিনি আসতে পারেননি। অর্পিতার কথায়, ‘‘ছেলের পরীক্ষার টেনশনে রাতে ঘুম হয়নি। প্রথম দিনের পরীক্ষা বলে কথা। কয়েকটা পরীক্ষা হয়ে গেলে হয় তো টেনশন কমবে।’’ শহরের বাসিন্দা অশোক ঘোষ বাগদা ব্লক গ্রামীণ হাসপাতালে কর্মরত। ছেলে বিশ্বরূপ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে বলে এ দিন তিনি ছুটি নিয়েছিলেন। ছেলে এবং স্ত্রী কাকলিকে নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে এসেছিলেন। বললেন, ‘‘রাতে উত্তেজনায় বার বার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। সাড়ে ৫টার সময়ে উঠে পড়েছিলাম। ওর মা রান্না করে ছেলেকে খাইয়ে দিয়েছে।’’
চন্দন ঘোষের মেয়ে চিত্রমিতা এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে। কয়েক দিন ধরে মেয়ে অসুস্থ। চন্দন টোটো চালান। এ দিন অন্য টোটোতে মেয়েকে নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে এসেছিলেন। সঙ্গে এসেছিলেন চিত্রমিতার মা ও দাদু। চন্দন এ দিন কাজে যাননি। তাঁর কথায়, ‘‘টোটো তো রোজই চালাই। মেয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষা তো বার বার ফিরে আসবে না। মেয়েটার শরীরও ভাল না। তাই নিজে এসেছি পৌঁছে দিতে।’’
ভাঙড়ের নারায়ণপুর হাইস্কুল থেকে এ বার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে সুয়াইবা খাতুন। তার সিট পড়েছে ঘটকপুকুর হাইস্কুলে। মা সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। বাবা পড়াশোনার সুযোগ পাননি। এ বার তাঁদেরই একমাত্র মেয়ে মাধ্যমিক দিচ্ছে। চিন্তায় ঘুম উড়েছে বাবা-মায়ের। পরীক্ষার প্রথম দিন নিজের অটো করেই মেয়ে ও স্ত্রীকে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে দেন সুরাইয়ার বাবা সাইফুল। পরীক্ষা চলাকালীন রাস্তার ধারে অসুস্থ শরীর নিয়েই অপেক্ষা করলেন মা সানজুরা বিবি। তাঁর কথায়, ‘‘পরিবারের মধ্যে মেয়েই প্রথম মাধ্যমিক দিচ্ছে। ও ভাল করে পরীক্ষা দিক, এটাই প্রার্থনা করছি।’’ বনগাঁর কুমুদিনী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের বাইরে বসেছিলেন ইন্দ্রাণী সরকার। আয়ার কাজ করেন। স্বামী রঙের কাজ করেন। তাঁর মেয়ে এ বার মাধ্যমিক দিচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘ ভোর সাড়ে ৫টায় ঘুম থেকে উঠে মেয়েকে প্রস্তুত হতে সাহায্য করেছি। মেয়ের পরীক্ষার জন্য কাজ বন্ধ রেখেছি।’’
শিল্পী বিশ্বাসের মতো কয়েক জন অভিভাবক অবশ্য বলেন, ‘‘আমাদের তেমন উদ্বেগ নেই। সন্তানের প্রস্তুতি ভাল হয়েছে। পরীক্ষাও ভাল দেবে।’’
পরীক্ষা শুরুর আগে কুমুদিনী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের বাইরে কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়ে বসেছিলেন এক ছাত্রীর মা। পরীক্ষা শেষে ছাত্রীটি বেরিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। হাসি ফিরল মায়ের মুখে। বললেন, ‘‘এতক্ষণ খুব চিন্তায় ছিলাম। মেয়ের পরীক্ষা ভাল হয়েছে জেনে খুব আনন্দ হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy