পরিত্যক্ত: সোদপুর স্টেশনে সত্যব্রত বর্ধন। বুধবার। নিজস্ব চিত্র
আদমসুমারি হলে তাঁর মাথা কেউ গুনবে কি না, জানেন না তিনি। গণতান্ত্রিক কোনও প্রার্থী তাঁর ভোট চাইবেন কি না, তা-ও অজানা তাঁর। চালচুলো না থাকলেও নিজের ভোটটা শুধু দিতে চান সত্তর পার করা সত্যব্রত বর্ধন।
তিনি ভবঘুরে নন। ঠিকানাও ফুটপাত নয়। তবে যেখানে তিনি থাকেন, সেই রেল স্টেশন ফুটপাতেরই নামান্তর। গত ছ’মাস ধরে সোদপুর স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে টিকিট কাউন্টার সংলগ্ন চাতালই তাঁর ঘরবাড়ি। খান তিনেক ঝোলা, দু’টি জলের বোতল আর একটা লাঠিই সম্বল অসুস্থ ও অশক্ত ওই বৃদ্ধের।
মাস ছ’য়েক আগের কোনও এক সকালে ‘বাবা, এই আসছি’ বলে একমাত্র ছেলে তাঁকে স্টেশনে বসিয়ে চলে গিয়েছিলেন। আর ফেরেননি। নিজের কিছু কাগজপত্র, ব্যাঙ্কের পাসবই, সামান্য টাকাকড়ি যা ছিল, সবই খোয়া গিয়েছে। বার্ধক্যভাতা পেতেন। কাগজপত্র খুইয়ে এখন তা-ও আর পান না। যাতায়াতের পথে এখন অনেকেই চেনা হয়ে গিয়েছে তাঁর। তাঁদের সাহায্যই ভরসা। এখন যাঁকে সামনে পাচ্ছেন, তাঁকেই বলছেন, ‘‘আমি ভোটটা দিতে চাই। একটা ব্যবস্থা করুন।’’ সত্যব্রতবাবু জানান, বরাবর এমন অবস্থা ছিল না তাঁর। নিজের বাড়ি ছিল দক্ষিণ দমদম পুরসভার সাতগাছি বটতলার প্রতাপাদিত্য কলোনিতে। কাজ করতেন এক বেসরকারি সংস্থায়। ভাল আয়ও করতেন এক সময়ে। চাকরি থেকে তিনি অবসর নেওয়ার কিছু দিন পরে স্ত্রী মারা যান। একমাত্র ছেলের নাম ইন্দ্রনীল বর্ধন। স্ত্রীর মৃত্যুর পরে ছেলের সঙ্গেই থাকতেন তিনি।
সমস্যা শুরু হয় বছর দু’য়েক আগে থেকে। বৃদ্ধ বলেন, ‘‘সাধ্যমতো টাকা দিয়ে ছেলেকে সাহায্য করেছি। এক সময়ে জমানো টাকা প্রায় ফুরিয়ে আসে।’’ তার পর থেকেই ছেলে তাঁর কাছে বাড়িটি লিখে দেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন বলে বৃদ্ধের অভিযোগ। তাঁর দাবি, ছেলে তাঁকে বলেন, বাড়ি তাঁর নামে লিখে দিলে সেখানে ফ্ল্যাটবাড়ি তোলার ব্যবস্থা করবেন তিনি। তাঁকে বোঝানো হয়েছিল, ফ্ল্যাটবাড়ি হলে তাঁরা সেখানে দু’টি ফ্ল্যাট এবং অনেক টাকা প্রোমোটারের কাছ থেকে পাবেন।
আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
বছরখানেক আগে ছেলেকে বাড়িটি লিখে দেন সত্যব্রতবাবু। এ দিকে, তত দিনে তাঁর সঞ্চিত অর্থের ভাণ্ডার প্রায় শূন্য। এলাকার কাউন্সিলর কস্তুরী চৌধুরী বার্ধক্যভাতার ব্যবস্থা করে দেন। বাড়িতে বসেই এক দিন পড়শিদের কাছ থেকে বৃদ্ধ জানতে পারেন, ছেলে সেই বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছেন। সত্যব্রতবাবু বলেন, ‘‘এক দিন ছেলে আমাকে বলল, ‘আমি সোদপুরের এইচবি টাউনের যেখানে থাকি, সেখানে তোমাকেও নিয়ে যাব।’ এই বলে স্টেশনে রেখে চলে গেল। আর কখনও আসেনি।’’ চশমার পুরু কাচের নীচে চোখ ভিজে যায় বৃদ্ধের। জল গড়িয়ে পড়ে শীর্ণ গাল বেয়ে।
বৃদ্ধ বলেন, ‘‘প্রথম বার হাত পাততে খুব কষ্ট হয়েছিল, জানেন! কিন্তু তা ছাড়া আর উপায় তো ছিল না।’’ তবে ছেলেকে নিয়ে তেমন আক্ষেপ নেই তাঁর। তিনি বলেন, ‘‘শুনেছি, ছেলে দেনার দায়ে বিকিয়ে গিয়েছে। আমাকে দেখার সামর্থ্যও হয়তো ওর নেই।’’ ধীরে ধীরে অনেকেই চেনা হয়ে উঠেছেন তাঁর। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির গবেষক ঐন্দ্রিলা চৌধুরী তেমনই এক জন। তিনি কখনও ওষুধ, কখনও বা খাবার কিনে দেন। কেউ দিয়েছেন গরম জামা। কেউ বা নতুন পোশাক হাতে দিয়ে যান। এলাকার বাসিন্দা অম্বরীশ নাগ বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমরা এইচবি টাউনের বাড়ি বাড়ি ওঁর ছবি নিয়ে ঘুরেছি। ছেলের সন্ধান পাইনি। শেষে নাগেরবাজারের কাউন্সিলর কস্তুরী চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করি।’’
কস্তুরী বলেন, ‘‘আমরা ওঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর খুঁজে পেয়েছি। প্রশাসন সাহায্য করলে উনি নিশ্চয়ই বার্ধক্যভাতা পাবেন। ভোটও দিতে পারবেন।’’ ওই বৃদ্ধের ছেলেকে অবশ্য মনোরোগী বলতে নারাজ মনোবিদ মোহিত রণদীপ। তিনি বলেন, ‘‘আসলে আজকাল বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়েদের আর সকলের থেকে আলাদা করে মানুষ করছেন। তারা না চাইতেই সব পেয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেই লুকিয়ে থাকছে স্বার্থপরতার বীজ। যার ফলে পরবর্তীকালে তাদের আত্মকেন্দ্রিক দুনিয়ায় বাবা-মায়েরও ঠাঁই হচ্ছে না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy