Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Struggle of Mother

শূন্য ও পূর্ণের মাঝে তাঁরা মা-ও

কাকদ্বীপ থেকে এক জনের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল কায়নাত। সে প্রায় দশ বছর আগের কথা। তখন কায়নাত ১৬ বছরের কিশোরী।

অঙ্কন: কুণাল বর্মন।

অঙ্কন: কুণাল বর্মন।

মোনালিসা ঘোষ
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:৪২
Share: Save:

মেঘ-রোদের খেলা হল অনেক। এ বছরের পুজো হেমন্তের শুরুতে। নতুন জামাকাপড়ের সঙ্গী তাই হাল্কা হিমের পরশ। ছাতিম ফুলের গন্ধে ঝিম মেরে রয়েছে পাড়া। ফুটপাতে শুয়ে দিনের হিসেব করে কায়নাত। এ বার কি তা হলে তাকে রাস্তা থেকে তুলে দেবে পুলিশ? ভিড়ের মধ্যে কোথায় থাকবে সে? সম্বল কিছুই নেই। তবু, রাতে নিশ্চিন্তে শুতে পারবে তো? ফাটা, তুলো বের হওয়া পুতুলটাকে আঁকড়ে ধরে। নাকের কাছে নিয়ে এসে গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করে। পাচ্ছে না তো! ছাতিমের গন্ধটা এত তীব্র যে মেয়ের গন্ধটাই হারিয়ে যাচ্ছে।

কাকদ্বীপ থেকে এক জনের সঙ্গে পালিয়ে এসেছিল কায়নাত। সে প্রায় দশ বছর আগের কথা। তখন কায়নাত ১৬ বছরের কিশোরী। স্বপ্ন দেখেছিল, সংসার করবে। এক সপ্তাহের মধ্যে সে বুঝেছিল, ভুল করেছে। এক বছরের মধ্যে মেয়ে হয়েছিল। নাম দিয়েছিল নাদিয়া। কিন্তু, মেয়ের জন্মের পরই সঙ্গী পালাল। মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় ভিক্ষে করত কায়নাত। মেয়েকে একা রেখে যেতে ভয় পেত। তবু পেটের দায়। কত দিনই বা ভিক্ষে করে চলতে পারে। রাস্তার জোগাড়ের কাজ নিল। প্রথম কাজের টাকা পেয়ে মেয়েকে পুতুল কিনে দিয়েছিল। কিছু দিন ঠিকঠাকই চলছিল। এক দিন কাজ থেকে ফিরে দেখে, তিন বছরের মেয়েটা নেই প্লাস্টিকের ছাউনির ঘরে। খোঁজ খোঁজ। পুলিশ এল। গুরুত্ব দিল না। দু’দিন পর একটা পুরনো বাড়ি থেকে রক্তাক্ত মেয়েটাকে মিলল। প্রাণ ছিল না। পাশে পড়ে ছিল পুতুলটা।

শেষ দেখবে, ভেবেছিল কায়নাত। লড়াইটা তো শক্ত ছিলই। হেরে গেল। আর কাজ করে না কায়নাত। ভিক্ষে করে। আঁকড়ে ধরে থাকে পুতুলটাকে। রোজ সকালে একটা মেয়ে কায়নাতের সামনে রাখা ফাটা থালায় ছুঁড়ে দিয়ে যায় ‘কয়েন’। তার অপেক্ষায় সকাল থেকে বসে থাকে কায়নাত।

.....

হাওড়ায় ট্রেন থেকে নেমে দৌড় লাগায় বসুমতী। কোন্নগরের বছর তিরিশের বসুমতী জানে, এক মিনিটের দেরি মালকিন কিছুতেই বরদাস্ত করবেন না। এই কাজটা খোয়ালে সংসার টানবে সে কী করে? মন কু গাইতেই ফের পড়িমড়ি দৌড় শুরু তার। বাসে একটা সিট পেতে তবে যেন খানিক স্বস্তি পায় বসুমতী। জানলার ধারের হাওয়ায় কখন যেন চোখ বুজে আসে। পুজো এলেই একটা গান খুব গাইতে ইচ্ছে করে বসুমতীর— ‘অমল ধবল পালে...’। সুর তো কবে হারিয়ে গিয়েছে। তবে ভাল লাগে ছাতিমের গন্ধ। কেমন যেন ঘোর ধরায়। মাথার ভিতরে ঘুরতে থাকা সব কথা, অতীত ভিড় করে আসে। মনে পড়ে, কত সাধ করে বাবা-মা বিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলে ভিন্‌ রাজ্যে কাজ করে। হোটেলে। ৬ মাস ছাড়া স্বামী আসত। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরেও এসেছিল। ছেলেকে নিয়ে ভদ্রেশ্বরের শ্বশুরবাড়িতেই থাকত বসুমতী। তার পর করোনা এসে সব কেমন যেন তছনছ করে দিল। পইপই করে স্বামীকে বারণ করেছিল, হেঁটে বাড়ি ফিরতে। সেটাই কাল হল! রেললাইনে ট্রেন এসে ফালাফালা করে দিয়েছিল তাকে। দেহ দেখতে পায়নি বসুমতী। দশ বছরের ছেলেটাকে নিয়ে জলে পড়েছিল। কী করবে ভেবে পায়নি। এখন সংসার টানতে কাজ নিয়েছে এক বৃদ্ধাকে দেখাশোনার। পুজোর সময় কাজ করতে পারলে টাকা বেশি। একটু বেশি সাশ্রয় করতে পারবে ছেলেটার জন্য। এক ভিখিরিকে পুতুল কোলে বসে থাকতে দেখে বসুমতী। বড় মায়া হয়। প্রতিদিন নিয়ম করে পয়সা দেয় সে। ট্রেনে আসার সময় এক দিদির সঙ্গে আলাপ হয়েছে বসুমতীর। তার সঙ্গে কথা বললে প্রাণ জুড়োয়। তার জীবনের ক্ষতও তো পূরণের নয়।

....

ট্রেনের উপর আর ভরসা করতে পারছে না আত্মজা। প্রতিদিন এই ট্রেনের জন্য সরকারি চাকরির খাতায় লাল কালির দাগ পড়ে। নীল আকাশে চোখ রেখে হিসেব করতে থাকে আত্মজা। আর কতটা পথ পেরোলে নিজের মেয়েকে স্বনির্ভর করতে পারবে সে? মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার মেনে নেয়নি সে। গার্হস্থ্য হিংসার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। আদালতের রায়ে মেয়ের অধিকার বুঝে নিয়েছিল আত্মজা। ২৮ বছরে দু’বছরের মেয়েকে কোলে করে বাপের বাড়ি চলে এসেছিল সে। কিন্তু আর একটা লড়াই শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই। শুরু হয়েছিল চাকরির পরীক্ষা দেওয়া। প্রথমে সাফল্য আসেনি। এক সময় তার মনে হয়েছিল, আর বোধ হয় কোনও পথ খুলবে না। হঠাৎ একদিন বাড়িতে এসেছিল সরকারি চাকরির চিঠি। সেই শুরু। এখন লড়াই মেয়েকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর। আত্মজা বিশ্বাস করে, স্বনির্ভর না হলে স্বাধীনতা মেলে না। পুজো এলেই এই ছাতিমের গন্ধে মন ভাল হয়ে যায় আত্মজার। তাই তো মেয়ের নামও রেখেছে, ‘ছাতিম’। পুজোর ছুটিতেই কিছুটা মুক্তি মেলে আত্মজার। ট্রেনের পথেই বসুমতী নামে এক মহিলার সঙ্গে আলাপ হয়েছে তার। সে-ও নিজের ছেলের জন্য লড়ছে। দু’জনের জগৎ আলাদা হলেও জীবনের লড়াইয়ে বসুমতীকে নিজের পাশের সৈনিক বলেই মনে করে আত্মজা।

....

মেয়েটার উপর এ বার বিরক্তি ধরে যাচ্ছে। রোজ দেরি লেগেই রয়েছে! সকাল আটটায় এসে রাত আটটায় যাওয়ার কথা। বছর সত্তরের প্রকৃতিদেবী এখন আয়া সেন্টারের পাঠানো বসুমতী বসু-র উপর নির্ভরশীল। একার জগতে একটা সঙ্গী পাওয়া গিয়েছে। না হলে ঘুড়ির মতোই তো ভেসে চলেছেন। এ বার সুতো কাটলেই হল! বনেদি বাড়িতে বিয়ে হয়েছিল। তারা রক্ষণশীলও। একমাত্র ছেলে বিনায়ককে নিয়ে মেতে ছিলেন তিনি। তাকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নাচ আর আঁকার স্কুলে নিয়ে যাওয়া, পড়াতে বসানো, সংসারের কাজ একা হাতে সব সামলেছেন। ছেলে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারেন, সে অন্যদের মতো নয়। শিক্ষিত বিনায়কও বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছিল, সে শরীরে পুরুষ হলেও মনে নারী। তাই সে নারীই হতে চায়। ছেলের এমন ইচ্ছের কথা জানতে পেরে পড়শি, পরিজনরা দুষেছিলেন মাকেই। কেন ছেলেকে নাচ শেখানো হয়েছিল! প্রকৃতি কিন্তু প্রথম থেকেই ছেলের পাশে। সেটাই কি ক্ষতি করে দিল ছেলেটার? এখনও উত্তর খোঁজেন প্রকৃতিদেবী। মাকে পাশে পেয়ে স্বপ্নপূরণে লাগামছাড়া মনোভাব এসে গিয়েছিল বিনায়কের। তেমনই একটা অপারেশনের পর আর হুঁশ ফেরেনি ছেলের। সন্তান হারানোর বেদনা কুরে কুরে খায় সত্তরের বৃদ্ধাকে। আগে মা-ছেলে বসে দক্ষিণের বারান্দা থেকে কোলাহল দেখা চলত। এখন সেই সেই জনস্রোতকে শুধু ভিড় মনে হয় প্রকৃতিদেবীর। শুধু তাই নয়, ছেলে নিজে হাতে আবাসনের নীচে একটা ছাতিম গাছ বসিয়েছিল। সেই প্রিয় গাছও কেটে দিয়েছেন তিনি।

....

বসুমতী কাজে এলে গল্প ভাগ করে নেন প্রকৃতিদেবী। বসুমতীর কাছে শোনেন আত্মজার কথাও। রাতে ফুটপাতে পুতুল জড়িয়ে শুয়ে থাকা ভিখারির দিকে তাকিয়ে থাকেন। জানতে ইচ্ছে করে তার কথাও। পুজোর শহরে রাত বাড়ে। কোলাহলের আড়ালে অভিজাত এলাকায় দশ তলার ফ্ল্যাট বাড়ির বারান্দা আর ফুটপাত মিলে যায় এক শূন্যতায়।

অন্য বিষয়গুলি:

woman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy