যাত্রিবাহী নৌকো ও মাছের ট্রলারের যাতায়াত চলছে । এতে বিপদের আশঙ্কাও রয়েছে। —নিজস্ব চিত্র।
ব্রিটিশ আমল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে ক্রমে ক্রমে গুরুত্ব বেড়েছে নামখানার। কলকাতা থেকে মালবাহী জাহাজ মুড়িগঙ্গা, হাতানিয়া-দোয়ানিয়া হয়ে জামিরা, সপ্তমুখী নদী দিয়ে বাংলাদেশের খুলনা, বরিশাল ছাড়াও মায়ানমারের দিকেও চলাচল করত সে সময়ে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচলের ইতিহাসও এ শহরের অজানা নয়।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার উপকূল এলাকা থেকে যে সামুদ্রিক মাছ আসে, তার সিংহভাগই যাতায়াত করে নামখানা মৎস্য বন্দর দিয়ে। তাই কয়েক হাজার মৎস্য ব্যবসায়ী ও শ্রমিক কাছেই এই বন্দর-শহরের গুরুত্ব যথেষ্ট। বহু মানুষের রুজি-রোজগারের প্রাণকেন্দ্র নামখানা। মুড়িগঙ্গা এবং সপ্তমুখী নদীর সঙ্গে যুক্ত হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদীতে নাব্যতা সব সময়ে বেশি থাকার জন্য জোয়ার-ভাটার তোয়াক্কা না করেই ট্রলার ভিড়তে পারে সহজে। যা ব্যবসার পক্ষে সুবিধাজনক।
এই ঘাটে মাছ ব্যবসার পুরোভাগে রয়েছে ‘সাউথ সুন্দরবন মৎস্যজীবী ও মৎস্য কর্মচারী সংগঠন’। সংগঠনের সভাপতি মোজাম খান বলেন, ‘‘এখানে অনেক সুবিধা। কিন্তু তা-ও বেশ দুর্বল পরিকাঠামো নিয়ে চলতে হচ্ছে। ব্যবসা বাড়ছে না। অথচ, কাকদ্বীপে এ রকম প্রাকৃতিক নাব্যতার সুযোগ না থাকলেও সেখানে মৎস্য দফতরের তরফে প্রচুর টাকা ঢেলে বন্দরের সুবিধা বাড়ানো হচ্ছে।’’ তাঁর দাবি, কাকদ্বীপে লট ৮ –এর পাশে পূর্বগঙ্গাধরপুরে মৎস্যবন্দর নাব্যতার কারণে ধুঁকছে। নিয়মিত ভাবে সেখানে মাছ নিয়ে আসা ট্রলার ভিড়তে পারে না। কিন্তু সেখানেই আরও অনেক টাকা খরচ করে একটি ড্রাই ডক এবং সরকারি খরচে একটি বরফ কল তৈরি করা হচ্ছে। অথচ, বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে নামখানা।
কেন এই পরিস্থিতি?
সুন্দরবন উন্নয়নমন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরার দাবি, মহকুমা শহর হিসেবে কাকদ্বীপের যা উন্নয়ন হওয়ার, তা হবে। পাশাপাশি নামখানাতেও বন্দর হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে সে জন্য।’’ কিন্তু মৎস্য দফতরের কর্তাদের কথায় ইঙ্গিত মিলেছে, তা এখনও দূরঅস্ত। সহমৎস্য অধিকর্তা (সামুদ্রিক) সন্দীপকুমার মণ্ডলের কথায়, ‘‘বন্দর তৈরির জন্য এলাকায় সমীক্ষার কথা আলোচনা হয়েছে। সমীক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার পরে সম্ভাবনা বুঝলে প্রকল্প তৈরি হতে পারে।’’
স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীদের দাবি, বকখালি, ফ্রেজারগঞ্জ-সহ গভীর সমুদ্র থেকে রোজ মাছ ধরে আসা প্রায় ২০০ ট্রলার আসে এই নামখানার ঘাটে। সন্ধে থেকে ট্রলারের ভিড় বাড়তে থাকলেও স্থান সংকুলান হয় না। বার্জঘাটের পর থেকে ফিস ল্যান্ডিং ঘাটের তিনটি কংক্রিট জেটির মধ্যে একটি ভেঙে গিয়েছে বহুকাল। বাকি দু’টির অবস্থা বেশ আশঙ্কাজনক। তার মধ্যেই ভোর রাত পর্যন্ত মাছ নিয়ে দৌড়োদৌড়ি চলে। ছোটখাটো দুর্ঘটনাও যে ঘটে না, তা নয়। নিকাশি, পানীয় জল এবং আলোরও সমস্যা রয়েছে। বার্জঘাটের জেটির মুখে বড় পোস্টের মাথায় ছাতার মতো আলো রয়েছে, কিন্তু সেগুলি অনেক সময়েই রাতে জ্বলে না বলে দাবি মৎস্যশ্রমিকদের। চোখে পড়ল কমিউনিটি হল। ঘাট-লাগোয়া এই হলে মৎস্যজীবীদের একটু জিরিয়ে নেওয়া, হঠাৎ অসুস্থতার কারণে ন্যূনতম প্রাথমিক চিকিৎসা— এ সবের জন্য ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা এখন ব্যবহার হচ্ছে বার্জ চলাচলের দায়িত্বে থাকা অফিসারদের থাকার জন্য।
হাতানিয়া-দোয়ানিয়া নদীর উপরে নতুন ব্রিজ তৈরি শুরু হওয়ার পর থেকে বার্জঘাটের পাশে ফিসল্যান্ডিং ঘাটেই যাত্রীবাহী নৌকোর অস্থায়ী ঘাট সরিয়ে আনা হয়েছে। ভোর থেকে প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত যাত্রী পরিষেবা চালু থাকে। সন্ধে থেকে মাছ নিয়ে ট্রলারও ভিড়তে শুরু করে। সব মিলিয়ে হুলস্থূল অবস্থা।
যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী যানের মধ্যে ধাক্কা লাগার আশঙ্কা থাকে। ঘাটের আলোও টিমটিম করে জ্বলে। যে কোনও দিন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, আশঙ্কা এলাকাবাসীর। নামখানা থেকে নারায়ণপুরের দিকে খেয়া পারাপার করেন প্রাথমিক শিক্ষক সুশীল পাত্র। তাঁর কথায়, ‘‘যাত্রীবাহী নৌকোর সঙ্গে ট্রলারের ধাক্কা লাগার উপক্রম হচ্ছে অনেক সময়েই। ঈশ্বরীপুর থেকে নাদাভাঙার দীর্ঘ এলাকায় যে কোনওখানে যাত্রীবাহী ঘাট সরিয়ে নেওয়া হলে ভাল হতো।’’ কাকদ্বীপের মহকুমাশাসক অমিত নাথ অবশ্য বলেন, ‘‘ঘাটের একেবারে একপ্রান্তে যাত্রীবাহী নৌকো ভিড়ছে। মাছধরা ট্রলারের সঙ্গে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’’
নামখানায় ব্যবসা আরও গুরুত্ব পায় কলকাতা-বকখালি রোড ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়কে উন্নীত হওয়ার পর থেকে। সড়ক পথে ব্যবসা বাড়তে শুরু করে কলকাতার বড় বাজারগুলির সঙ্গে। বকখালি, ফ্রেজারগঞ্জের দিক থেকে হাতানিয়া-দোয়ানিয়া পেরিয়ে প্রচুর পানচাষিও নামখানা হয়ে আসেন কাকদ্বীপের পাইকারি বাজার ধরার জন্য।
হাতানিয়া-দোয়ানিয়ার উপরে সেতু হলে যোগাযোগ ব্যবস্থার অনেকটা সুবিধা হবে, মানছেন সকলেই। তবে যত দিন সেতু তৈরি শেষ না হচ্ছে, কিছু অসুবিধা যে থাকবেই, তা-ও বিলক্ষণ পাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy