প্রতীকী ছবি।
দিনেদুপুরে প্রকাশ্যে খুন। যাকে খুন করা হচ্ছে, কিছু ক্ষণ আগে তাঁর সঙ্গে বসেই চলেছে সিগারেটে টান বা মদ্যপান। মুহূর্তেরতফাতে অনায়াসে বুলেটবিদ্ধ হচ্ছে সঙ্গী। কখনও এক থালায় ভাত খাওয়া বন্ধু, কখনও আবার পরিচিত প্রতিবেশী।
শনিবার ১৬ ঘণ্টার তফাতে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের ভাটপাড়ায় দু’টি খুন একটা প্রশ্নই তুলছে, এত সাহস কোথা থেকে আসে? এলাকায় বেআইনি অস্ত্রের জোগান, দুষ্কৃতীদের অবাধ দাপাদাপি কী ভাবে বাড়ছে— সেই সব প্রশ্ন ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে এই প্রশ্নটাই। শনিবার দিনেরবেলায় ভাটপাড়া পুরসভার ১২ নম্বর ওয়ার্ডে চা, সিগারেটের আসরে মহম্মদ সালাউদ্দিন আনসারিকে (৩৫) যারা খুন করল আর মধ্যরাতে মদের আসর শেষে নিজের ঘরের দোরে রোহিত দাসকে (১৮) যে গুলি করে মারল, তারা যে শুধু নিহতদের পরিচিত এমনটাই নয়, একই এলাকার বাসিন্দা। খুনের পরে ধরা পড়ার ভাবনা তাদের মাথায় আসেনি না কি খুন করলেও জেলে বেশি দিন আটকে থাকতে হবে না, এই নিশ্চয়তার বলয়ে তারা রয়েছে, সেই সব প্রশ্ন উঠেছে প্রশাসনের কর্তাদের মনেই।
ব্যারাকপুরের ভাটপাড়া, কাঁকিনাড়া, জগদ্দল, কামারহাটি এলাকায় খুন বা অপরাধমূলক কাজ নতুন নয়। মাসখানেক আগে রামপুরহাটের বগটুইগ্রামে হত্যাকাণ্ডের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেখানে গিয়ে বেআইনি অস্ত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। রাজ্যের সমস্ত জেলার প্রশাসনিক আধিকারিকদের প্রতি তাঁর স্পষ্ট বার্তা ছিল, বেআইনি অস্ত্র আটক করতে তৎপর হতে হবে। তার পরেও ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে এখনও যথেষ্ট পরিমাণে বেআইনি অস্ত্রমজুত রয়েছে বলে দাবি করেছেন জগদ্দলের তৃণমূল বিধায়ক তথা শিল্পাঞ্চলের শ্রমিক নেতা সোমনাথ শ্যাম। তাঁর দাবি, ‘‘২০১৯ সালের পর থেকেই ভাটপাড়ায় গুলি, বোমার একটা অপ্রীতিকর পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। ওই সময়ে বিজেপি এই এলাকায় অস্ত্র ছড়িয়েছিল। তার সবটা পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি এখনও। অতি সম্প্রতি বেশ কিছু দুষ্কৃতী জামিনে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে। তারা এলাকায় ঢুকে পরিবেশ অশান্ত করে তুলছে।’’ পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা অবশ্য এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘গত তিন বছরের নিরিখে এ বছর এখনও পর্যন্ত দুশোর বেশি বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র আটক করা হয়েছে। মূলত, ভিন্ রাজ্য থেকেই দুষ্কৃতীদের হাত ঘুরে এখানে অস্ত্র ঢোকে।’’
সূত্রের খবর, সোমনাথ নাম না করলেও এটা স্পষ্ট যে, সাংসদ অর্জুন সিংহ ২০১৯ সালে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে এলাকার পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়েছিল। সম্প্রতি তিনি তৃণমূলে ফিরেছেন। শ্যামনগরে সভা করে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এলাকায় শান্তি বজায় রাখার কথা বললেও সোমনাথ ও অর্জুনের মতবিরোধ প্রকাশ্যে আসছে বার বার। শনিবার সালাউদ্দিন খুনের পরে অর্জুন সিংহ টাকাপয়সা নিয়ে গোলমাল ও সালাউদ্দিনের পুলিশের খাতায় নাম থাকার বিষয়ে বলেছিলেন। সোমনাথের প্রতিক্রিয়ায় উঠে আসে সালাউদ্দিনের তৃণমূলের একনিষ্ঠ কর্মী হওয়ার বিষয়টি।রবিবারও তিনি বলেন, ‘‘বহু দুষ্কৃতীকে আদালত জামিন দিয়ে দিয়েছে। তারা জেল খেটে এসে শুধরে যাবে মনে হয়েছিল। কিন্তু তেমন হল না।’’ বিষয়টি নিয়ে অর্জুন সিংহ বলেন, ‘‘এলাকায় অপরাধ যাতে না বাড়তে পারে, এক জন সাংসদ হিসেবে সেই ভাবনা আমার রয়েছে। পুলিশ চেষ্টা করছে। আর আদালতকে আমি সব সময়ে মান্যতা দিই।’’
শুধুই কি দুষ্কৃতীদের জামিন পাওয়াটাই অপরাধ বাড়ার কারণ? প্রশাসনের কর্তাদের মত অবশ্য পুরোপুরি ভিন্ন। জেলা প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, ‘‘ব্যারাকপুর এখন একটা ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেডবডি’-তে পরিণত হয়েছে। বহু কারখানা আগাছায় মোড়া। চটকলগুলোর গতি রুদ্ধ হয়েছে। গঙ্গার ধারে যে কারখানাগুলো আর চালু করা যাবে না, সেখানে সফ্টওয়্যার টেকনোলজি পার্ক করার কথা কি ১০ বছর আগে থেকে ভাবা যেত না? আসলে এখানে ক্ষুদ্র রাজনীতির লড়াই আছে, বৃহত্তর ভাবনা নেই।’’ সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ১১ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাবিশিষ্ট এই শিল্পাঞ্চলে বর্তমান জনসংখ্যা ৪০ লক্ষেরও বেশি। কিন্তু গত দু’দশকে যে হারে কলকারখানা বন্ধ হয়েছে, সেই হারে বিকল্প পেশার সংস্থান হয়নি।
মূলত চটশিল্প এই এলাকার অর্থনীতির কাণ্ডারী হলেও তরুণ প্রজন্মের এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় অনীহা রয়েছে। এশিয়ার বৃহত্তম হুকুমচাঁদ চটকলের সিইওসমীরকুমার চন্দ্রের কথায়, ‘‘ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করছেবলেই হয়তো একের পর এক চটকল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরিশ্রমবিমুখ এই প্রজন্ম খুঁজছে সহজ উপার্জনের পথ। পা বাড়াচ্ছে অন্ধকারজগতে।’’ আর ভাটপাড়ার বাসিন্দারা বলছেন, ‘‘লাগামহীন রাজনৈতিক অবস্থানই এই এলাকায় অশান্তির পরিবেশ জিইয়ে রাখছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy