Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪

শিল্পের জৌলুষ হারিয়ে কমেছে বিশ্বকর্মার বাহার

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ছোট গল্পে নায়ককে লুকোনোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের হালিশহরকে। চটকল-সহ তখন সেখানে কারখানার রমরমা।

ছবি পিটিআই।

ছবি পিটিআই।

সুপ্রকাশ মণ্ডল
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:১৮
Share: Save:

গঙ্গা থেকে অর্ধেক উঠে যে সিঁড়িটা হারিয়ে গিয়েছে ঝোপের মধ্যে, এক সময়ে সেই সিড়ির উপরে পাইপ-কপিকল লাগানো থাকত। গঙ্গার ঘাটে এসে ভিড়ত নৌকো। যন্ত্র করে কাপড়ের গাঁট উঠত তাতে। যেত বড় বাজারে। সিঁড়ি গঙ্গায় তলিয়েছে অনেক দিন আগেই। কারখানার গেটও আর গঙ্গার ঘাট থেকে নজরে পড়ে না। এ কারখানা ইছাপুরের।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ছোট গল্পে নায়ককে লুকোনোর জন্য বেছে নিয়েছিলেন ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের হালিশহরকে। চটকল-সহ তখন সেখানে কারখানার রমরমা। প্রচুর মানুষের ভিড়ে তখন অচেনা কাউকে চেনা দায়। আগে কারখানার সাইরেনে সময় দেখত এ শিল্পাঞ্চল। এখন কান পাতলে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যায় বন্ধ কারখানার ভিতর থেকে। বিশ্বকর্মা পুজোয় সে দীর্ঘশ্বাস আরও দীর্ঘ হয়। কারণ, এক সময়ে এক দিনের এই পুজো ছিল শিল্পাঞ্চলের অন্যতম বড় উৎসব। প্রবীণেরা জানালেন, উৎসবের বহর আগে এমনটাই ছিল যে, এক দিনের পুজোতে গানবাজনা, যাত্রা-জলসা চলত তিন দিন ধরে। তখন কারখানার রমরমা ছিল।

টিটাগড়ের বাসিন্দা শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী এক সময়ে একটি চটকলের ম্যানেজার ছিলেন। তিনি জানান, বরাহনগর-আগরপাড়া থেকে শুরু করে কাঁচরাপাড়া পর্যন্ত এক সময়ে গঙ্গার পাড়ে গড়ে উঠেছিল প্রচুর কল-কারখানা। তুলনায় শ্রমিক কম পড়ত। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শ্রমিকেরা এসেছিলেন। কিন্তু কালক্রমে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।

কারখানা বন্ধের শুরুটা হয় বাম আমলের মাঝামাঝি। অধিকাংশই একমত যে, বামেদের শ্রমিক সংগঠন আন্দোলনের নামে দিনের পর দিন কারখানা বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল। দাবিদাওয়া আদায়ে আলোচনার পাশাপাশি কাজ চালিয়ে যাওয়ার পদ্ধতিটাই উঠে যায় তখন। দিনের পর দিন বন্ধ থাকায় নাভিশ্বাস ওঠে কারখানাগুলির। ফলে অনেকে কারখানা গুটিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যান। অনেকে কারখানা বন্ধ করে দেন। বেকার হয়ে পড়েন হাজার হাজার শ্রমিক। বাসন্তী কটন মিল, পলতা বেঙ্গল এনামেল, নিকো কেবলস, মোহিনী মিল, শ্যামনগর অন্নপূর্ণা কটন মিল, নৈহাটি গৌরীপুর জুটমিল, ইনটেক টায়ার ফ্যাক্টরি, জেনসন নিকলসন, রামস্বরূপ উদ্যোগ-সহ বহু বড় কারখানা বাম আমলে ঝাঁপ বন্ধ করে। বেকার শ্রমিকদের কেউ অন্য পেশায় যেতে বাধ্য হন। অনেকে কাজ না পেয়ে নিজের মুলুকে ফিরে যান।

বার বার কারখানা খোলার প্রয়াস সরকারি স্তরে হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। তণমূল আমলেও কারখানা বন্ধের ছবি বদলায়নি। ডাকব্যাক, হিন্দুস্তান হেভি কেমিক্যালস, টেক্সম্যাকো, পানিহাটি প্রিয়া বিস্কুট, উইমকো, পানামা ব্লেড, ইন্ডিয়া ফয়েল, প্রয়াস পেপার মিল বন্ধ হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। আরও শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।

কাঁচরাপাড়ার বাসিন্দা সুফল দেবনাথ বলেন, ‘‘বড় কারখানা বন্ধ হওয়ায় ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছিল। কিন্তু ওই কারখানাগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল ছোটখাটো বহু কারখানা বা ব্যবসা। বড় কারখানা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যবসাগুলিও তলিয়ে যায়।’’ বহু বাসিন্দা জানালেন, এক সময়ে শিল্পাঞ্চলের রমরমা ছিল। তখন বড় কারখানাগুলির সঙ্গে সঙ্গে ছোট কারখানাগুলিতেও ধুমধাম করে বিশ্বকর্মা পুজো হত। তাকে ঘিরে নানা বাউল-কবিগানের পাশাপাশি সব কারখানার শ্রমিকদের যৌথ উদ্যোগে যাত্রাপালার আসর বসত।

এক সময়ে এখানে দুর্গাপুজোর সুর বাঁধা হয়ে যেত বিশ্বকর্মা পুজোতেই। দেশের প্রায় সব প্রান্ত থেকে শ্রমিকেরা এসেছিলেন বলে এক সময়ে এই শিল্পাঞ্চলকে বলা হত ‘মিনি ভারতবর্ষ।’ কারখানা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকেরাও এলাকা ছাড়তে শুরু করেন। সেই ট্রাডিশন এখনও চলছে। গুটিয়ে আসছে মিনি ভারতের পরিসর।

অন্য বিষয়গুলি:

Barrackpore Industrial Belt Vishwakarma Puja Economy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy