অজানা নম্বর থেকে ফোন ধরে লোনের ব্যবস্থা বারাচ্ছে সমস্যা। প্রতীকী চিত্র।
সহজ শর্তে মিলছে মোটা অঙ্কের ঋণ।
অনলাইনে কয়েকটি বোতাম টিপলেই টাকা ঢুকে যাচ্ছে অ্যাকাউন্টে।
মনে হতে পারে, টাকা তো ঢুকছে। কাজেই প্রতারণা ঘটছে কই!
কিন্তু এই ফাঁদে পা দিলেই ফোনে থাকা সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য-ছবি পৌঁছে যাচ্ছে সংস্থার কাছে। এরপরেই অনেক বেশি টাকা চোকানোর জন্য ফোন করছে সংস্থা। না পেলে ব্যক্তিগত ছবি বিকৃত করে চলছে ব্ল্যাকমেল। এ ভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বহু মানুষ। দিশেহারা হয়ে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছেন অনেকে।
সম্প্রতি একটি অনলাইন সংস্থা থেকে দশ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন বারাসতের বাসিন্দা কৃষ্ণপদ বিশ্বাস। আট দিন পর সংস্থার তরফে তাঁকে বলা হয়, সুদ-সহ ১৫ হাজার টাকা ফেরত দিতে হবে। বারো দিন পরে ফের ফোন পান কৃষ্ণপদ। তাঁর কাছে চাওয়া হয় ৪৮ হাজার টাকা। অল্প দিনে এত সুদ কেন? প্রশ্নের উত্তরে আসে হুমকি। জানানো হয়, টাকা না দিলে তাঁর ফোনে থাকা পরিবারের সদস্যদের ছবি, ফোন নম্বর ‘বাঁকা পথে’ ব্যবহার হবে। কয়েক ঘণ্টা পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপে আসে পরিবারের এক মহিলার বিকৃত ছবি। কিছুক্ষণের মধ্যে কৃষ্ণপদের পরিচিত কিছু মানুষ জানান, তাঁদের কাছেও ওই বিকৃত ছবি ও কুমন্তব্য পৌঁছে গিয়েছে।
সংস্থার তরফে ফের বলা হয়, টাকা না দিলে তাঁর পরিচিত সকলের কাছে সমস্ত ছবি পাঠিয়ে সামাজিক সম্মান নষ্ট করা হবে।
এই ঘটনায় মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন কৃষ্ণ। পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন তিনি। পুলিশ তাঁকে পরামর্শ দেয়, টাকা ফেরত না দিতে। সংস্থার কোনও ফোনও না ধরতে। এরপর আর ওই সংস্থার ফোন আসেনি।
শুধু কৃষ্ণপদ নন, দেশ জুড়ে একই ভাবে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বহু মানুষ। এর মধ্যে দুই ২৪ পরগনারও অনেকে রয়েছেন।
রাজ্যের সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, অনলাইনে ঋণ আবেদন করার সময়ে নির্দিষ্ট সংস্থার অ্যাপ ‘ইনস্টল’ করতে হয়। সে সময়ে বেশ কিছু বিষয় ‘অ্যাকসেস’ বা অধিকারের অনুমতি চাওয়া হয়। এর মধ্যে মোবাইলে সেভ করা নম্বর, ছবি গ্যালারি ইত্যাদি থাকে। গ্রাহকের কাছে দু’টি মাত্র ‘অপশন’ দেওয়া হয়— এড়িয়ে যান অথবা অনুমতি দিন। এড়িয়ে গেলে অ্যাপটিতেই আর ঢোকা যায় না। বাধ্য হয়ে গ্রাহকেরা ‘অনুমতি দিন’ অপশনটি বেছে নেন।
এরপরেই ফোনের সার্ভারের কর্তৃত্ব সংস্থার হাতে চলে যায়। গ্রাহকের সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি পৌঁছে যায় প্রতারকদের হাতে। শুরু হয় ব্ল্যাকমেল। ঋণ নেওয়া অঙ্কের কয়েকশো গুণ পর্যন্ত বেশি টাকা আদায় করা হয় বলে উঠছে অভিযোগ।
এই ভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন দত্তপুকুরের এক মহিলাও। তিনি বলেন, ‘‘ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিতে হলে অনেক কাগজ জমা করতে হয়। সময়ও লাগে বেশি। অনলাইনে ঋণ নিতে প্যান কার্ড, আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নম্বর দিয়েছিলাম। মুহূর্তের মধ্যেই ৩০ হাজার টাকা ঢুকে গেল অ্যাকাউন্টে।
ওই মহিলার কথায়, ‘‘আমার ছবি এমন ভাবে বিকৃত করে পাঠিয়েছিল, দেখে চমকে উঠি। ভয় দেখানো হয়, ওই ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। বাধ্য হয়ে ঋণ নেওয়ার মাসেই তিন কিস্তিতে ৭০ হাজার টাকা ফেরত দিই। সব মিলিয়ে পরে প্রায় ২ লক্ষ টাকা মিটিয়েছি। তারপরেও টাকা চাওয়া হচ্ছিল। সারারাত কান্নাকাটি করতাম। পরে পুলিশের কাছে যাই। পুলিশ টাকা দিতে বারণ করে। এরপরে ফোন আসাও বন্ধ হয়।’’
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রের খবর, বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ পেয়ে বিষয়টি নিয়ে মাস ছয়েক আগে তদন্ত শুরু হয়। উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, শুধু ঋণ সংস্থা নয়, প্রতারণার এ ধরনের ৫০টির বেশি অ্যাপ আছে। এগুলি চিন থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয় বলে জানতে পারছেন গোয়েন্দারা। সংস্থার তরফে নিয়োগ করা হয় স্থানীয় লোকেদের। কিছু দেশিয় সংস্থার অ্যাপও ইদানীং একই পদ্ধতিতে প্রতারণা শুরু করেছে বলে অভিযোগ। সম্প্রতি প্রতারণা রুখতে সরকারের তরফে বেশ কিছু পদক্ষেপ করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার এক আধিকারিক জানান, সম্প্রতি ১৩৮টি বেটিং অ্যাপ ও ৯৪টি ঋণ দেওয়ার অ্যাপ নিষিদ্ধ ও ব্লক করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক মাস ছয়েক আগে ২৮টি চিনা ঋণসংস্থার অ্যাপ নিয়ে তদন্ত শুরু করে। দেখা যায়, এই জাতীয় ৯৪টি অ্যাপ ঋণ দেওয়ার নাম করে ফাঁদ পেতে ব্যবসা করছে। পাশাপাশি চলছিল গুপ্তচরবৃত্তি। এতে নাগরিকদের তথ্যের নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা ছিল। এরপরেই অ্যাপগুলি নিষিদ্ধ করতে পদক্ষেপ করা হয়।
গোটা বিষয়টি নিয়ে জেলার সাইবার বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, প্রতারকেরা নিত্যনতুন পদ্ধতিতে ফাঁদ পাতছে। সাধারণ মানুষকে আরও সতর্ক হতে হবে। বেশি সময়, একাধিক নথির ঝক্কি থাকলেও ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়াই সুরক্ষিত। তা ছাড়া, যে কোনও অ্যাপ ইনস্টল করার সময়ে কী কী তথ্য দেখার অনুমতি দিচ্ছেন গ্রাহক, তা অবশ্যই দেখে নিতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত তথ্য-ছবি শেয়ার না করাই ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy