হাবড়া হাসপাতালে জ্বরে আক্রান্ত রোগীর ভিড়। ছবি: সুজিত দুয়ারি
সংখ্যাটা হাজার হাজার। রোজই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জ্বর-ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা। গত ৪ দিনে উত্তর ২৪ পরগনায় নতুন করে ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন হাজার মানুষ। চলতি মরসুমে জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা সব মিলিয়ে ১৬ হাজার ছাড়িয়েছে!
হাবড়া, গাইঘাটা, দেগঙ্গা, বিধাননগর, দক্ষিণ দমদম— খবর আসছে নানা প্রান্ত থেকে। আশা করা গিয়েছিল, শীতের শুরুতে অন্তত প্রকোপ কমবে। কিন্তু কোথায় কী! মশার কামড় শুধু তো আর জ্বালা-যন্ত্রণায় থেমে নেই। একের পর এক প্রাণ চলে যাচ্ছে। কখনও এ জন্য প্রশাসনকে দুষছেন মানুষ। কখনও প্রশাসন জানাচ্ছে, মানুষ সচেতন না হলে ডেঙ্গি কমবে কী করে। কিন্তু এই চাপানউতোরের মাঝে পড়ে মানুষের দুর্ভোগ তো কমছে না। চিকিৎসকেরা অনেকে জানাচ্ছেন, দেরিতে হাসপাতালে আসায় নাকি কখনও-সখনও মারণ রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গি।
ভুক্তভোগী বহু পরিবারের আবার দাবি, বাইরে থেকে রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গি ধরা পড়লেও মৃত্যুর পরে হয় তো সে কথা লেখাই হচ্ছে না শংসাপত্রে। আবার জ্বর নিয়ে শুরু শুরুতে হাসপাতালে গেলেও তো ডাক্তারবাবুরা দু’টো প্যারাসিটামল হাতে গুঁজে ছেড়ে দিচ্ছেন। বাড়ি ফিরে ফের জ্বর। এমনকী, হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা করিয়ে অনেককে ছেড়ে দিচ্ছে হাসপাতাল। দু’দিনের মাথায় ঘুরে আসছে জ্বর। ফের হাসপাতালের চক্কর কাটতে হচ্ছে। তাতে প্রাণও যাচ্ছে অনেকের।
ডেঙ্গিতে আক্রান্তের সংখ্যা যে বেড়েই চলেছে, সে কথা জানিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য দফতর। তবে মঙ্গলবার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক তপন সাহা জানান, জেলার কিছু অংশে সমস্যা থাকলেও অন্যান্য উপদ্রুত এলাকায় জ্বর-ডেঙ্গির হার এ ক’দিনে কমতে শুরু করেছে।
২০১৭ সালে এই জেলায় ডেঙ্গি পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিয়েছিল। মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে শাসক-বিরোধী চাপানউতোর বিধানসভা পর্যন্ত গড়ায়। আশা করা গিয়েছিল, পরের বছরগুলিতে ডেঙ্গি মোকাবিলায় আগে থেকে ঢাল-তরোয়াল নিয়ে কোমর বাঁধবে প্রশাসন। বছরের প্রথম দিকে সেই কাজ বেশ গতিও নিয়েছিল। কিন্তু মাঝে ঢিলেমি এসে গিয়েছে বলে অভিযোগ নানা এলাকায়। হাবড়া পুরসভায় প্রশাসক বসায় ডেঙ্গি মোকাবিলার কাজ গতি হারিয়েছে, এমনও অভিযোগ।
২০১৮ সালে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল ডেঙ্গি। কিন্তু এ বার সে আগের মতোই আক্রমণাত্মক। এর আগে এই জেলায় যে এলাকায় ডেঙ্গিতে সর্বাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল, সেই দেগঙ্গায় জ্বর ও ডেঙ্গির হার মঙ্গলবার পর্যন্ত একই রয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। প্রতিদিন সেখানে এক হাজারেরও বেশি মানুষ জ্বর নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। তাঁদের মধ্যে গড়ে ১৫ জনের প্রতিদিন ডেঙ্গি ধরা পড়ছে বলে স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান।
তবে চলতি বছরে ডেঙ্গিতে সব থেকে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে হাবরা-অশোকনগরে। ইতিমধ্যে সেখানে জ্বর ও ডেঙ্গিতে সেখানে মারা গিয়েছেন ২৩ জন। হাবড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, রোজই জ্বর-ডেঙ্গি নিয়ে মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ডেঙ্গি আক্রান্ত প্রায় ৫০ জন মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এই হাসপাতালে ডেঙ্গি রোগী আসছেন মূলত হাবড়া, অশোকনগর ও গাইঘাটা ব্লক এলাকা থেকে। তবে হাবড়া শহরে জ্বর-ডেঙ্গির প্রকোপ কমেছে। হাসপাতালের সুপার শঙ্করলাল ঘোষ বলেন, ‘‘ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসা রোগীর সংখ্যা কমেছে। কিন্তু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। দুর্গাপুজোর আগে গড়ে দিনে দেড়শো রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন এমনও হয়েছে। এখন সংখ্যাটা কমে হয়েছে ৪০-৫০ জন। ডেঙ্গি নিয়ে মানুষ সচেতন হচ্ছেন বলেই আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে বলে মনে করেন তিনি।
বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে বুধবার পর্যন্ত প্রায় ৮০ জন ডেঙ্গি আক্রান্ত রোগী ভর্তি রয়েছেন। হাসপাতাল সুপার শঙ্করপ্রাসাদ মাহাতো বলেন, ‘‘মাঝে মধ্যে বৃষ্টির ফলে নতুন করে বর্ষার জল জমছে। তার ফলে ডেঙ্গির মশা বংশবৃদ্ধি করছে নতুন করে।’’ জেলাশাসক চৈতালি চক্রবর্তী জানিয়েছেন, ডেঙ্গি প্রতিরোধে নিয়মিত মশা মারতে তেল-ব্লিচিং-ধোঁয়া ছড়ানো হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে জ্বর ডেঙ্গির খোঁজ নিচ্ছেন। রক্ত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ডেঙ্গি প্রতিরোধে যা যা করা উচিত, তা করা হয়েছে।’’
তপনবাবুর দাবি, যেখানে যেখানে রোগ ছড়িয়েছিল বেশি, সে সব জায়গায় পরিস্থিতি এখন তুলনায় নিয়ন্ত্রণে। প্রতি সপ্তাহে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার পরে উপদ্রুত এলাকাগুলিকে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য দফতর ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মীরা গিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। তবে পুজোর সময় থেকে থেকে থেকে বৃষ্টিতে জল জমার সমস্যা পুরোপুরি এড়ানো যায়নি। প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ হয়নি বহু এলাকায়। ফলে গোল্লায় গিয়েছে নিকাশি। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জানিয়েছেন, তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রির নীচে নেমে এলে পরিস্থিতি আরও নিয়ন্ত্রণে আসবে।
রোগ মোকাবিলায় প্রকৃতির খামখেয়ালই কি তবে শেষ ভরসা, সে প্রশ্নই এখন ঘুরছে জেলার আনাচ-কানাচে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy