আশ্রয়ের আশায়। — নিজস্ব চিত্র।
প্রতি বছর উৎসব আসে। তেমন আসে ঘূর্ণিঝড়ও। ফুলে ফেঁপে ওঠে নদী-সমুদ্র। ভাসিয়ে দেয় ঘর গেরস্থালি, চাষজমি, সঞ্চয়— সব কিছু। বছর ঘুরতে না-ঘুরতে দুর্যোগের এমন আসা-যাওয়া এক প্রকার গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে উপকূলের মানুষজনের। ঝড়ের পূর্বাভাস পেলেই সাইক্লোন সেন্টার ছাড়াও অনেকে প্রতিবেশীর পাকা বাড়িতে মাথা গোঁজার জন্য আশ্রয় নেন। এই বিপদের সময় প্রতিবেশীরাই একমাত্র ভরসা।
ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের পূর্বাভাস জারি হওয়ার পর থেকেই আতঙ্কে উপকূলের মানুষ। তাই অন্যান্য বারের মতো এ বারও প্রতিবেশীদের জন্য নিজের বাড়িতে জায়গা রাখতে ভোলেননি সাগরদ্বীপের কচুবেড়িয়ার বাসিন্দা অনন্যা বেরা। অনন্যার স্বামী পেশায় ব্যবসায়ী। কাকদ্বীপে দোকান রয়েছে তাঁর। আশপাশে কাঁচা বাড়ির ভিড়ে পাকা বাড়ি অনন্যাদের। আয়লা, আমপান এবং ইয়াসের সময় জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল গোটা এলাকা। সেই সময় অনন্যাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রতিবেশীদের অনেকেই। আগের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বারও অতিথিদের জন্য বাড়িতে জায়গা রেখেছেন তাঁরা।
অনন্যাদের বাড়ির একটি ঘর এখন খালি। চাল, ডালের পাশাপাশি শুকনো খবারও তাঁরা মজুত করে রেখেছেন বাড়িতে। অনন্যার কথায়, ‘‘স্বামী-সন্তানকে নিয়ে আমার সংসার। প্রত্যেক বার ঝড়ে মুড়িগঙ্গা নদী আমাদের এলাকা ভাসিয়ে দেয়। মাটির বাড়ি ভেসে যায় জলে। তখন পাড়ার অনেকেই আমাদের বাড়িতে এসে ওঠেন। প্রতিবেশী দিদি, বোনেরা কয়েক দিন আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেন। তাই তাঁদের জন্য কিছু কিছু ব্যবস্থা করি।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এ বারও চাল, ডাল আর আলুর বস্তা আগে থেকে কিনে রেখেছি। মুড়ি চানাচুর, বাতাসাও রাখা আছে। জানি না দুর্যোগে মানুষ কত দিন ঘরছাড়া থাকবেন। তবে যা আছে তাতে বেশ কিছু দিন খাবার পাবেন তাঁরা।’’
কোনও অসুবিধা হয় না? অনন্যার জবাব, ‘‘আসলে বিপদেআপদে কাছের মানুষ বলতে প্রতিবেশীরাই। একে অপরকে জাপটে ধরে বেঁচে থাকার কথা শিখিয়েছে এই প্রকৃতিই। বাড়িঘর জলে ভেসে গেলেও মন তো ভেসে যায় না আমাদের। আমাদের পাকা বাড়ি আছে। কিন্তু ওদের নেই। তাই বলে দুর্যোগের সময় কি ওরাও ভেসে যাবে? আর ফ্লাড সেন্টার কিংবা স্কুলবাড়িতেও সব লোক ধরেও না।’’
ঝড়ের খবর পেয়ে অনন্যার বাড়িতে ছুটে এসেছিলেন স্থানীয় গিরিপাড়ার বাসিন্দা মধ্য পঞ্চাশের রমা হাজরা। তিনি বলেন, ‘‘ঝড় নিয়ে ভয় নেই আর। তবে এলাকা প্লাবিত হলে বাড়িঘর সব কিছু ভেসে যায়। তখন থাকার জায়গা থাকে না। তাই প্রতিবেশীর পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। এমনটাই চলছে বিগত কয়েক বছর ধরে।’’ চরম হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আসলে আমাদের কিছু করার নেই। প্রকৃতিই আমাদের নাগপাশে বেঁধে রেখেছে।’’
রমার পাশেই দাঁড়িয়ে বছর ছাব্বিশের তরুণী মধুমিতা দাস। চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘প্রতি বার ঝড়ের সময় ধানের বস্তা, কাগজপত্র, লেপকম্বল সব খাটে তুলে দিতে হয়। যাতে ভিজে না যায়। গরু, ছাগল নিয়েই প্রতিবেশীর বাড়িতে চলে যাই। তবে জলস্তর বাড়ার আশঙ্কা থাকলে ফসল, কাগজপত্র বাঁচানোর আর কোনও উপায় থাকে না। মানুষই ঠিক করে যেখানে আশ্রয় নিতে পারে না সেখানে বাক্সপ্যাঁটরা, বস্তা এ সব কোথায় রাখব? অনেকের গবাদিপশু জলে ভেসে যেতে দেখেছি। জানি না এ বার কী হবে!’’
শুধু সাগরদ্বীপই নয়, এমন ছবি দক্ষিণ ২৪ পরগনার ঘোড়ামারা, মৌসুনি, নামখানা এবং পাথরপ্রতিমারও। সেখানকার সব কাঁচা বাড়ির বাসিন্দা মৎস্যজীবী, কৃষক, শ্রমিক এবং পাকাবাড়িতে থাকা মধ্যবিত্তদের এখন আরও বেঁধে বেঁধে থাকার সময়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy