বিধ্বস্ত: কুলতলির দেউলবাড়ি গ্রামের দশা। ছবি: সুমন সাহা
বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব। কিছুটা দূরে ফুঁসছে মাতলা নদী। একের পর এক গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ আসছে চারদিক থেকে। মাটির ঘরে তখন স্ত্রী, দুই ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এবং বৃদ্ধ মাকে আগলে বসে বছর পঁয়তাল্লিশের অনাদি হালদার। ভোরের দিকে যখন ঝড়ের তাণ্ডব কমল, ততক্ষণে গাছ পড়ে ভেঙে গিয়েছে চালের কিছুটা অংশ।
কোনও রকমে প্রাণে বেঁচেছে পরিবারটা। শনিবারের সেই রাতের কথা বলতে গিয়ে পাঁচ দিন পরেও আতঙ্ক কুলতলির দেউলবাড়ির বাসিন্দা অনাদির চোখেমুখে। ঝড়ের তাণ্ডব আরও একটু জোরাল হলে ঘর ভেঙে সেদিন বড় বিপদ হতে পারত বলে আশঙ্কা তাঁর।
শুধু অনাদিই নয়, দেউলবাড়ি গ্রামের নদী তীরবর্তী এই অংশের সকলেই প্রাণ হাতে করে কাটিয়েছেন সেই রাত। কারও চাল ভেঙেছে। কারও আবার ভেঙে পড়েছে পুরো ঘরটাই। ধ্বংসলীলার মধ্যেই অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচেছেন অনেকে। অভিযোগ, আবহাওয়া দফতরের সতর্কবাণী থাকার পরেও উপকূলবর্তী এই এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কোনও উদ্যোগই নেয়নি প্রশাসন। বৃহস্পতিবার মাতলা নদীর ধারে এই গ্রামে গিয়ে দেখা গেল ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছ সরিয়ে, খড়ের চাল মেরামত করে দৈনন্দিন ছন্দে ফেরার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন গ্রামবাসীরা। বুলবুল পরবর্তী সময়েও প্রশাসনের কেউ এগিয়ে এসে সাহায্য করেনি বলে অভিযোগ। এমনকী, আশেপাশে যে সমস্ত ত্রাণ শিবির হয়েছে, তার কথা জানেন না কেউই বলে জানিয়েছেন তাঁরা।
দেউলবাড়ির নদীতীরবর্তী এই এলাকায় অন্তত একশো পরিবারের বাস। ঝড়ে ক্ষতি হয়েছে সবারই। অধিকাংশ কাঁচা বাড়ি ভেঙে গিয়েছে। গাছ উপরেছে শ’য়ে শ’য়ে। ঝড়ের আগে জেলা প্রশাসনের তরফে উপকূলবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হলেও, এখানকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাঁদের উঠে যাওয়ার কথা বলেনি কেউ। কুলতলি ব্লকে একাধিক ত্রাণ শিবির রয়েছে। বুলবুলের জন্য সেখানে ত্রাণ শিবিরের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু শিবিরের কথা জানেন না গ্রামের প্রায় কেউই।
গ্রামবাসীরা জানান, ঝড়ের আগে-পড়ে শুকনো খাবার বা অন্য ত্রাণের ব্যবস্থাও হয়নি। অনাদি বলেন, ‘‘কেউ কোথাও যাওয়ার কথা বলেনি। কোথায় ত্রাণ শিবির হয়েছে তাই জানি না। এই ঘরেই পরিবার নিয়ে কোনও রকমে ছিলাম। গোটা রাতটা যে কী ভাবে কেটেছে বলে বোঝাতে পারব না। ঝড়ের পরেও তো কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। নিজেরাই উপড়ে পড়া গাছ কেটেছি।’’
স্থানীয় বাসিন্দা রেণু মণ্ডলের অভিযোগ, পঞ্চায়েত থেকে একটা কাগজে সই করিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এই পর্যন্তই। কেউ কোনও সাহায্য করেনি। ঝড়ের আগেও উঠে যাওয়ার কথা বলেনি কেউ।
নদীতে মাছ কাঁকড়া ধরেই সংসার চলে অনাদিদের। ঝড়ের পরেও সেই কাজে বিরাম নেই। বাড়ির চালে পড়ে থাকা গাছ কাটার পাশিপাশি নিয়মিত জঙ্গলেও যাচ্ছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা দিন আনি দিন খাই। সংসারটা তো চালাতে হবে। জঙ্গলে না গেলে খেতে পাব না। তাই এ দিকে কাজ সামলে জঙ্গলেও যেতে হচ্ছে নিয়মিত।’’
স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান সতীশ সর্দারের অবশ্য দাবি পঞ্চায়েতের তরফে মাইকে করে প্রতিটি এলাকার মানুষকে ফ্লাড শেল্টারে উঠে যাওয়ার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু অনেকেই সেই অনুরোধ না শুনে বাড়িতে থেকে গিয়েছিলেন। ঝড়ের পর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির পাশে দাঁড়ানো প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘পঞ্চায়েতের তরফে কোথায় কী ক্ষতি হয়েছে তা পরিমাপ করে ব্লক স্তরে রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ স্থানীয় বিধায়ক সিপিএমের রামশঙ্কর হালদার বলেন, ‘‘মানুষগুলিকে নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে না যেতে পারাটা প্রশাসনিক ব্যর্থতা তো বটেই। প্রচুর মানুষের ঘর ভেঙেছে। তাঁদের সকলের জন্য ন্যূনতম একটা ত্রিপলের ব্যবস্থা সরকার করে উঠতে পারছে না। যা দেওয়া হয়েছে তা এখনও পর্যন্ত পর্যাপ্ত নয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy