ভোগান্তি: ইছামতীর জল বাড়লে এভাবেই প্লাবিত হয় বেড়িগোপালপুর বাজার। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
গত পাঁচ বছর ধরে রাজনীতির লড়াইয়ের শেষে কী পেলেন মানুষ? প্রতিশ্রুতি পালনে কতটা সাফল্য এল বিধায়কের ঝুলিতে? কী বলছে জনতা? বিরোধীদেরই বা বক্তব্য কী— এ সবেরই খতিয়ান জানাবে রিপোর্ট কার্ড। আনন্দবাজারের পাতায় শুরু হল বিধানসভাভিত্তিক ধারাবাহিক প্রতিবেদন।
সময় কম পাননি বিধায়ক। পর পর দু’বার একই কেন্দ্রের দায়িত্ব সামলেছেন। কিন্তু তারপরেও বিধায়ক সুরজিৎ বিশ্বাসের হাত ধরে উন্নয়ন কতটা হল, প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে বনগাঁ দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের বাতাসে।
এলাকায় নদী-বাওর সংস্কারের দিকে কেউ নজর দিল না, মনে করেন স্থানীয় মানুষ। যশোর রোড সম্প্রসারণের কাজও হল না। ছিল সেতুর দাবি। তা হয়নি। আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের চাহিদা থেকেই গেল। আমপানের পরে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল কোণায় কোণায়। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় পাচারকারীদের দাপট আছে। তাদের হাত ধরে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরাও ঢুকে পড়ে এলাকায়।
সব মিলিয়ে দু’দফায় গত দশ বছরে বিধায়ক সুরজিতের ভূমিকা নানা ভাবে প্রশ্নের মুখে। গত লোকসভা ভোটে এই এলাকায় তৃণমূলকে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে বিজেপি। সামনের ভোটে সেই সব ক্ষত মেরামত করে অনুন্নয়নের অভিযোগের জবাব দিয়ে ঘর গোছাতে হবে তৃণমূলকে, মনে করছে দলেরই একটা বড় অংশ।
বিধানসভা কেন্দ্রটির জন্মলগ্ন থেকেই তৃণমূল এখানে দাপট দেখিয়েছে। সুর কাটে গত লোকসভা ভোটে। বিজেপি প্রার্থী এখানে প্রায় ২৯ হাজার ভোটে এগিয়ে যান। বনগাঁ ও গাইঘাটা ব্লকের ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে বনগাঁ দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রটি তৈরি হয় ২০১১ সালে বিধানসভা ভোটের আগে। ওই কেন্দ্র থেকে পর পর দু’বার জয়ী হয়ে বিধায়ক হয়েছেন তৃণমূলের সুরজিৎ বিশ্বাস। ১২টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১১টি শাসক দলের দখলে। দু’টি পঞ্চায়েত সমিতিও তৃণমূলের দখলে।
তা হলে লোকসভায় ভরাডুবির কারণ কী?
তৃণমূল নেতৃত্ব মনে করেন, বামেদের ভোট বিজেপির দিকে চলে যাওয়া ছিল এর পিছনে বড় কারণ। চাঁদপাড়া এলাকায় আনাজ বাজার তুলে কিসান মান্ডিতে নিয়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে রোজগার নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। তারও প্রভাব পড়েছিল লোকসভা ভোটে। তবে শাসক দলের নেতাদের মধ্যে অনৈক্য, কিছু নেতার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি, স্বজনপোষণের অভিযোগেরও কি কিছুমাত্র ভূমিকা ছিল না, প্রশ্ন তোলেন দলের নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের অনেকে।
বিতর্ক চলছেই। ইতিমধ্যে বিজেপি ১টি পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখল করেছে। লোকসভা ভোটেও তাদের ফল নজরকাড়া। তৃণমূলের বিরুদ্ধে আমপান দুর্নীতির অভিযোগ তুলে নিয়মিত কর্মসূচি নিয়ে চলেছে তারা। তবে দলীয় কোন্দল বিজেপির মাথা ব্যথার কারণ এই এলাকায়। হারানো রাজনৈতিক জমি ফেরাতে তৎপর বাম নেতৃত্ব। তারাও নিয়মিত কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে জনসংযোগ বাড়াচ্ছে। পুরনো বসে যাওয়া কর্মীরা সক্রিয় হচ্ছেন। নতুন প্রজন্ম দলে আসছে।
একটা সময়ে ফসলের খেত উজাড় করে গরু পাচার চলত বহু এলাকায়। সে সব এখন বন্ধ। তবে পাচার পুরোপুরি রুখতে না পারলে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে না বলে মনে করেন বাসিন্দারা।
বনগাঁ দক্ষিণ বিধানসভা এলাকায় প্রচুর খাল-বিল-নদী-বাওর আছে। নদী-খাল সংস্কারের অভাবে মজে যাওয়ায় জল ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। এখন বর্ষার মরসুমে নদীর জল কৃষি জমি ও লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। মানুষ আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ইছামতী ও যমুনার পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের দাবি দিন দিন জোরাল হয়েছে। অতীতে এলাকার অন্যতম নিকাশির মাধ্যম ছিল চালুন্দিয়া নদী। ওই নদী বিলুপ্তির পথে। অভিযোগ, নদীর জমি জবরদখল হয়ে গিয়েছে। বেআইনি নির্মাণ গড়ে উঠেছে। ‘চালুন্দিয়া নদী বাঁচাও মঞ্চ’ করে আন্দোলন করছেন মানুষ। পার্বতী খালও সংস্কারের অভাবে মৃতপ্রায়।
বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক প্রদীপ সরকার বলেন, “নহাটা বাজার এবং সংলগ্ন এলাকার জল নিকাশির প্রধান মাধ্যম ছিল পার্বতী খাল। খাল মজে যাওয়ায় নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। খাল থেকে কচুরিপানা তোলা ছাড়া খাল সংস্কারে আর কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।” পাল্লা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে শয্যা সংখ্যা বাড়ানো এবং অপারেশন থিয়েটার চালুর দাবি আছে। চাঁদপাড়া বাজারে যশোর রোডে ক্রমবর্ধমান যানজট দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেড়ি গোপালপুর এলাকায় ইছামতী নদীর উপরে পাকা সেতুর দাবি মানুষের অনেক দিনের। বেহাল কাঠের সেতু দিয়ে মানুষ যাতায়াত করেন। প্রায়ই ঘটে দুর্ঘটনা।
অভিযোগ, এই এলাকায় বিভিন্ন ভুঁইফোড় অর্থলগ্নি সংস্থা মানুষকে ঋণের জালে জড়িয়ে সর্বস্বান্ত করেছে। দাবি রয়েছে কৃষিভিত্তিক শিল্পের। পাঁচপোতা এবং সংলগ্ন এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি আছে গ্রামবাসীদের।
বিধায়কের কাজকর্ম নিয়ে কী বলছে বিরোধীরা?
স্থানীয় বাসিন্দা তথা বিজেপি নেতা চন্দ্রকান্ত দাস বলেন, “এলাকার উন্নয়নে বিধায়কের ভূমিকা তেমন চোখে পড়েনি। তিনি বরং গাইঘাটা বিধানসভা কেন্দ্রের ঠাকুরনগরের উন্নয়ন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। ইছামতী নদী সংস্কারে ভূমিকা দেখা গেল না। প্রত্যন্ত এলাকায় রাস্তা বেহাল। উন্নত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নেই।” সিপিএম নেতা রমেন আঢ্য বলেন, “ইছামতী, যমুনা, চালুন্দিয়া নদী এবং চৈতা খাল, ফুলসরা খাল, পার্বতী খাল-সহ নদী-খাল-বিল সংস্কারের অভাবে মৃতপ্রায়। বাম আমলে ইছামতী সংস্কার হয়েছিল। তারপরে আর সংস্কার হয়নি। রাস্তা তৈরি, পুকুর কাটা-সহ বিভিন্ন কাজে কাটমানি নেওয়া হচ্ছে।”
কী বলছেন বিধায়ক সুরজিৎ। তাঁর কথায়, “মতুয়াদের ধর্মগুরু হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামাঙ্কিত বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির কাজ চলছে। টেন্ডার হয়ে গিয়েছে। শীঘ্রই ভাইস চ্যানসেলর নিয়োগ করা হবে। পাল্লা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামো উন্নতি করা হয়েছে। এলাকার ২০টি স্কুলে মুক্তমঞ্চ করেছি। এমন কোনও মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল বা কলেজ নেই যার পরিকাঠামো বাড়ানো হয়নি। রাস্তা, আলো, নিকাশি নালা, যাত্রী বিশ্রামাগার তৈরি করেছি।”
কিন্তু মানুষের দাবি তো আরও ছিল।
বিধায়ক বলেন, “ইছামতী ও যমুনা কচুরিপানামুক্ত করা হয়েছে। চালুন্দিয়া নদী জবরদখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা হয়েছে। বেআইনি নির্মাণ আটকেছি। বেড়ি গোপালপুর পাকা সেতু তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। নৈহাটি থেকে গঙ্গার জল আনতে দেরি হওয়ায় আর্সেনিক সমস্যার সমাধান করতে আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের নলকূপ সর্বত্র বসিয়েছি। পাচার বন্ধ করতে মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মাধ্যমে পদক্ষেপ করা হয়েছে।” ইছামতী সংস্কার বা আর্সেনিক সমস্যার পাকাপাকি সমাধানের দায়িত্ব অকা তাঁর নয় বলেও জানান সুরজিৎ। তাঁর মতে, এ ধরনের বড় প্রকল্পে ক্ষেত্রে কেন্দ্রের সহযোগিতা দরকার। যা সে ভাবে তাঁরা পাননি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy