সুনসান: বনগাঁ থানা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
থানা চত্বরে পুলিশ কর্মী ছাড়া আর কারও দেখা নেই। থানার ডিউটি অফিসার চেয়ারে গা এলিয়ে বসে থাকছেন। লকআপগুলো ফাঁকা। পুলিশ কর্মীদের ব্যস্ততা আছে, তবে তা অপরাধী বা দুষ্কৃতীদের ধরার জন্য নয়। তাঁরা ব্যস্ত লকডাউন পরিস্থিতি সামাল দিতে। তবে এই পরিস্থিতিতে কয়েকটি এলাকা থেকে বধূ নির্যাতনের বেশ কয়েকটি অভিযোগ এসেছে।
দিন পনেরো আগেও সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থানা চত্বরগুলো গমগম করত। মানুষ অভিযোগ করতে আসতেন। অভিযোগ পেয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটে যেতেন পুলিশকর্মীরা। অভিযুক্তদের ধরে এনে লকআপে রাখা হত। চলত জিজ্ঞাসাবাদ।
এখন কোনও অপরাধের ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশ ছুটছে, কার্যত এমন দৃশ্যের দেখা মিলছে না। বিভিন্ন সংগঠনের কর্মকর্তা রাজনৈতিক নেতা নেত্রীরাও থানার অধিকারিকদের সঙ্গে নানা প্রয়োজনে দেখা করতে আসতেন। এ সবও বন্ধ। পথ দুর্ঘটনাও কমে গিয়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসাবে লকডাউনের সময় অপরাধের রেখাচিত্র এখন বনগাঁ, বারাসত, বসিরহাট পুলিশ জেলায় এবং ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেট এলাকায় একধাক্কায় নেমে গিয়েছে অনেকটাই।
লকডাউন উপেক্ষা করে মানুষ বাজার-হাটে ভিড় করছেন। নিয়ম না মেনে দাঁড়িয়ে একাংশ মানুষ বাজার-হাটে ঘুরছেন। পুলিশ তা সামলাতে ব্যস্ত।
এক পুলিশ অফিসারের কথায়, ‘‘মানুষ যদি লকডাউন পরিস্থিতিটা পুরোপুরি মেনে চলতেন, তা হলে আমাদের ঘুমিয়ে বসে সময় কাটাতে হত।’’
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ১৫ দিনে বনগাঁ থানায় বিভিন্ন অভিযোগ হয়েছে ১৭টি। তার আগের পনেরো দিনে সংখ্যাটা ছিল ৩৭। বাগদা থানায় শেষ ১০ দিনে অভিযোগ হয়েছে মাত্র তিনটি। স্বাভাবিক সময়ে ১০ দিনে ১৫-২০টা অভিযোগ হয়। থানার ডিউটি অফিসারের সামনে বসার জায়গা এখন ফাঁকা থাকছে। অভিযোগ জানানোর লোক নেই। শুধু বনগাঁ থানা নয়, বনগাঁ পুলিশ জেলার অন্তর্ভুক্ত বাগদা, গাইঘাটা, পেট্রাপোল, গোপালনগর সর্বত্রই এখন থানা চত্বর ফাঁকা। গোপালনগরে গত আটদিনে অভিযোগ দায়ের হয়েছে মাত্র তিনটি। স্বাভাবিক দিনে ১৭-১৮টি অভিযোগ দায়ের হয়। গাইঘাটা থানায় শেষ ১৫ দিনে অভিযোগ হয়েছে ২০টি। অন্য সময় সংখ্যাটা থাকে ৫০-৬০টি। পেট্রাপোল থানায় গত ১৫ দিনে, তুলনায় ৪০ শতাংশ অভিযোগ কম জমা পড়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, লকডাউন পরিস্থিতিতে এবং করোনা আতঙ্কের জেরে দুষ্কৃতীরাও বাড়ির বাইরে খুব বেশি বের হচ্ছে না। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, কেপমারি, মাদক পাচার, মারপিট করতে কেউ বের হচ্ছেন না। বনগাঁ মহকুমার বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ থাকছে। রাতে বাজার এলাকায় নিরাপত্তা তেমন থাকছে না, এরপরও বাজারগুলি সুরক্ষিত রয়েছে করোনা আতঙ্কের কারণে।
বনগাঁর পুলিশ সুপার তরুণ হালদার বলেন, ‘‘থানায় শুধু এফআরআই নয়, জিডির সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছে। দুষ্কৃতীরাও আর বাড়ি থেকে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। রাতেও বাইক বা গাড়ি করে দুষ্কৃতীদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না। করোনা আতঙ্কের মধ্যেও যা স্বস্তি দিচ্ছে বনগাঁ মহকুমার মানুষকে।’’
তবে এরই মধ্যে নারী নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। কয়েকজন মহিলা পেট্রাপোল থানায় মৌখিক অভিযোগ করেছেন, স্বামীরা তাঁদের উপর শারীরিক মানসিক নির্যাতন করছেন। পুলিশ সেই সব বাড়িতে গিয়ে স্বামীদের নরমে গরমে বুঝিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে এসেছে। বনগাঁ শহরের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানালেন, আগে রাতে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরে আতঙ্কে থাকতাম। আশঙ্কায় রাত কাটত এই বুঝি খবর এল দোকানে চুরি হয়ে গিয়েছে। মহকুমায় সম্প্রতি দোকান, ফাঁকাবাড়ি, মন্দিরে একের পর এক চুরির ঘটনা ঘটছিল, যা পুলিশের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখন সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, রাতে এলাকায় পুলিশ টহল চলছে। কোনও রকম ঢিলেমি দেওয়ার জায়গা নেই। অপরাধহীন পরিস্থিতিতে পুলিশের কী ভাবে সময় কাটছে? পুলিশ কর্মীরা জানালেন, ২৪ ঘণ্টা সাধারণ মানুষ ফোন করছেন। তাঁরা জানাচ্ছেন, ভিন রাজ্য বা বিদেশ থেকে ফিরে লোকজন ঘরে না থেকে বাইরে বেরিয়ে পড়ছেন। পুলিশ গিয়ে তাঁদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসছেন। এই কাজেই তাঁরা এখন বেশি ব্যস্ত থাকছেন।
বারাসত ও বসিরহাট পুলিশ জেলাতেও গত ১৫ দিনে অপরাধ কমেছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন। থানাগুলোতে অভিযোগ উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। বারাসত পুলিশ জেলার অশোকনগর থানায় মাসে ৫০-৬০টি অভিযোগ জমা পড়ত। শেষ ১৫ দিনে সংখ্যাটা ১০-১২টি। বারাসত পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শেষ ১৫ দিনে পরিসংখ্যান বলছে থানায় অভিযোগ কমে গিয়েছে। তবে কী কারণে তা বলতে পারব না।’’ বসিরহাট পুলিশ জেলার অন্তর্গত বাদুড়িয়া থানাতে মাসে ৫০-৫৫টি অভিযোগ জমা পড়ে। শেষ পনেরো দিনে মানুষ অভিযোগ করেছেন ১০-১৫টি। বসিরহাট থানারও একই ছবি।সকাল হতেই বোমার শব্দে, আবার রাতদুপুরেও নাগরিকেরা বোমার শব্দে জেগে উঠতেন। মাস তিনেক আগেও এটাই ছিল ভাটপাড়া-কাঁকিনাড়া এলাকার রোজনামচা। তার জেরে জগদ্দল থেকে ভেঙে ভাটপাড়াকে আলাদা থানা করা হয়। শুধুমাত্র অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনতে সপ্তাহ দু’য়েক আগে খড়দহ থানা থেকে রহড়াকে আলাদা থানা করা হয়েছে। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে বছরভর অপরাধের সংখ্যা অন্য এলাকার তুলনায় অনেক বেশি থাকে। যার বেশির ভাগ হয় খুন বা খুনের চেষ্টা, সংঘর্ষ বা অস্ত্র আইন। কিন্তু লকডাউন পরবর্তী সময়ে সেই অপরাধের সংখ্যাও কমেছে। গত ১০ দিনে শিল্পাঞ্চলের থানাগুলিতে বড় কোনও অপরাধের অভিযোগ দায়ের হয়নি। বেশ কয়েকটি থানায় বধূ নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। লকডাউন না মেনে অকারণে রাস্তায় বেরিয়ে গ্রেফতারের সংখ্যা ১০০-র বেশি।
(তথ্য সহায়তা: নির্মল বসু, সুপ্রকাশ মণ্ডল)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy