অসহায়: চোখের জল শুকায়নি নিভা বিশ্বাসের ।
ঠিক এক মাস আগে নদিয়ার হাঁসখালিতে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ১৭ জনের। এঁদের মধ্যে ১৩ জনই ছিলেন পারমাদন ও সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা। দুর্ঘটনার পর কেটে গিয়েছে এক মাস। কেমন আছেন দুর্ঘটনায় মৃত ও জখমদের পরিবারের লোকেরা? সরেজমিনে দেখল আনন্দবাজার
দুর্ঘটনার পর গ্রামে এসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সবরকমের সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন রাজনৈতিক নেতা, সাংসদ, মন্ত্রী, বিধায়ক থেকে প্রশাসনিক কর্তারা। দুর্ঘটনার পর কেটে গিয়েছে এক মাস। এখনও দুর্ঘটনায় জখম মানুষেরা কোনও সরকারি আর্থিক সাহায্য পাননি। কী ভাবে চিকিৎসার খরচ আসবে, দুশ্চিন্তায় তাঁরা। জখমদের মধ্যে কেউ কেউ বাড়ির একমাত্র রোজগেরে ব্যক্তি। স্বাভাবিক ভাবেই সংসার চালাতে সমস্যায় পড়েছেন পরিবারগুলি।
উত্তর ২৪ পরগনার বাগদার পারমাদনের মুহুরি পরিবারের নবতিপর সদস্য শিবানী মুহুরির মৃত্যুর পর তাঁর দেহ নিয়ে নবদ্বীপে সৎকারের উদ্দেশে রওনা দেন মুহুরি পরিবারের অনেকেই। সঙ্গে ছিলেন প্রতিবেশীদের কয়েকজন। কিন্তু ওই রাতেই নদিয়ার হাঁসখালির ফুলবাড়ি মাঠের কাছে রাজ্য সড়কে দাঁড়িয়ে থাকা একটি পাথরবোঝাই লরিতে ধাক্কা মারে শববাহী গাড়িটি। তার জেরে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। মারা যান ১৭ জন।
দুর্ঘটনার পর বনগাঁর সাংসদ শান্তনু ঠাকুর এলাকায় গিয়ে ওই পরিবারগুলির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ওই সময় তিনি বলেছিলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মৃতদের জন্য ২ লক্ষ টাকা এবং জখমদের জন্য ৫০ হাজার টাকা অনুমোদন করেছেন। শীঘ্রই তাঁরা টাকা পেয়ে যাবেন।’’ কিন্তু ঘটনার পর এক মাস পেরিয়ে গেলেও পরিবারগুলির হাল ফেরেনি। কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদান পাননি কেউই। এই বিষয়ে শান্তনু বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল। গ্রামবাসীরা টাকা না পেয়ে থাকলে খোঁজখবর নিয়ে পদক্ষেপ করব।’’
এই বিষয়ে জেলাশাসক সুমিত গুপ্তা বলেন, ‘‘কারা কেন্দ্রের আর্থিক সাহায্য পাবেন তা পোর্টালে আপলোড করে দেওয়া হয়েছে। টাকা না পেয়ে থাকলে কেন পাননি তা খোঁজখবর নিয়ে দেখা হচ্ছে।’’
পারমাদন গ্রামের বাসিন্দা নিভা বিশ্বাস ঠিক ১ মাস আগের পথ দুর্ঘটনায় দুই ছেলে, ভাই, ভাইয়ের মেয়ে ও তাঁর দুই বোন বিভা সরকার ও সুচিত্রা বিশ্বাসকে হারিয়েছেন।
নিভার দুই ছেলে অমর ও অমলেন্দু বিশ্বাস মারা গিয়েছেন। দু’জনেরই ছোটখাট দোকান ছিল। অমলেন্দু ছিলেন বাড়ির একমাত্র রোজগেরে সদস্য। তাঁর মেয়ে কলেজে পড়ে। ছেলে ছোট। অমলেন্দুর স্ত্রী মল্লিকা বলেন, ‘‘কাপড়ের দোকানটি খোলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারছি না দোকান চালাতে। মেয়ের একটা কাজের ব্যবস্থা হলে একটু সুরাহা হত।’’ নিভার কথায়, ‘‘দুর্ঘটনা পর অনেকেই এসেছিলেন। পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না।’’
দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন সুকুমার বিশ্বাস। বাড়িতে রয়েছেন তাঁর ছেলে সমীর ও স্ত্রী শ্যামলী। সুকুমার চাষবাস করতেন। তাঁর আয়েই সংসার চলত। সমীর এ বছর স্নাতক হয়েছেন। রাজ্য সরকারের দেওয়া ২ লক্ষ টাকার চেক পেলেও সই সংক্রান্ত জটিলতার কারণে এখনও হাতে টাকা পাননি তাঁরা। শ্যামলীর কথায়, ‘‘আমাদের রোজগার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। ছেলের একটা কাজের ব্যবস্থা হলে সুরাহা হত। সকলের কাছেই কাজের আবেদন করেছি। কিন্তু এখনও কিছু হল না।’’
দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবারকে রাজ্য সরকার ২ লক্ষ টাকা করে আর্থিক সাহায্য করেছে। কিন্তু জখমেরা কোনও সরকারি সাহায্য পাননি। বর্তমানে বিছানায় শুয়ে দিন কাটছে দুর্ঘটনায় জখম বাদল সমাদ্দারের। মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখেছেন তিনি। এখনও আতঙ্কের স্মৃতি স্পষ্ট। শরীরে অস্ত্রোপচার হয়েছে। বুকে, পিঠে মারাত্মক চোট রয়েছে। বাড়িতে ফিরলেও উঠে দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতি নেই তাঁর। প্রাণে বাঁচলেও কী ভাবে সংসার চলবে, চিকিৎসার খরচ আসবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি। বাদলের স্ত্রী রিঙ্কু বলেন, ‘‘স্বামীর রোজগারেই সংসার চলত। ইতিমধ্যেই ওঁর চিকিৎসার পিছনে লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। আমাদের সঞ্চয় শেষ। সরকার পাশে না দাঁড়ালে কী ভাবে স্বামীকে সুস্থ করে তুলব জানি না।’’
একই পরিস্থিতির শিকার দুর্ঘটনায় জখম টিঙ্কু মণ্ডল। তাঁর আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। আগে তিনি দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন। দুর্ঘটনায় মুখে, হাতে আঘাত পেয়েছেন। ইতিমধ্যে দাঁতে অস্ত্রোপচার হয়েছে। হাতে অস্ত্রোপচার করা বাকি। টিঙ্কুর কথায়, ‘‘চিকিৎসার খরচ সামলে কী ভাবে সংসার চালাব বুঝতে পারছি না। দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবার সরকারি সাহায্য পেলেও আমরা কিছু পাইনি।’’
গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, অর্চনা মুহুরি, রবীন্দ্রনাথ মুহুরি, বাদল সমাদ্দার, টিঙ্কু মণ্ডল, অমিত মণ্ডলেরা দুর্ঘটনায় জখম হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গ্রামবাসীরা তাঁদের কিছুটা সাহায্য করছেন। স্থানীয় বাসিন্দা টিঙ্কু নন্দী বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক সাহায্য এখনও কেউ পাননি। গ্রামবাসীরা মিলে ওষুধ কিনে, বাজার করে সাহায্য করছি। তবে আমাদের সামর্থ্য আর কতটা।’’
দুর্ঘটনায় জখমদের চিকিৎসার বিষয়ে বাগদার তৃণমূল বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস বলেন, ‘‘জখমদের চিকিৎসার বিষয়টি রাজ্য সরকারের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করব।’’
দুর্ঘটনায় মৃতদের আত্মীয়েরা এখনও শোক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। স্বজন হারানোর যন্ত্রণার পাশাপাশি আতঙ্ক তাঁদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। এ বিষয়ে বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালের চিকিৎসক তথা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী বলেন, ‘‘যে কোনও ভয়াবহ মৃত্যু বা দুর্ঘটনার পর প্রত্যক্ষদর্শী ও তাঁদের আত্মীয়দের মনের ভিতর আতঙ্ক, উৎকন্ঠা ও ভয় দেখা দিতে পারে। মনোবিজ্ঞানে এই মানসিক অস্থিরতার নাম ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসর্ডার’। এক্ষেত্রে শোকপালনের পাশাপাশি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিলে মানসিক যন্ত্রণা কাটিয়ে ওঠা সহজ হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy