—প্রতীকী চিত্র।
চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকেই রাজ্যে স্নাতকস্তরে জাতীয় শিক্ষানীতি অনুসারী চার বছরের অনার্স ডিগ্রি কোর্স চালু হয়েছে। সঙ্গে চালু হয়েছে তিন বছরের ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি জেনারেল কোর্স’। মঙ্গলবার থেকে প্রথম সিমেস্টারের ক্লাস শুরুহয়েছে অনেক কলেজে। কিন্তু দু’জেলায় কলেজে ভর্তির সংখ্যা অনেকটাই কম।
কোনও কলেজে অনার্সে ভর্তির সংখ্যা কম। কোথাও আবার পাসকোর্সে ভর্তি হয়েছেন কম ছাত্রীছাত্রী। বনগাঁ দীনবন্ধু মহাবিদ্যালয় অনার্সে ১৬০০টি আসন রয়েছে। কলেজের অধ্যক্ষ বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, “অনার্সে এ বছর ভর্তি হয়েছেন মাত্র ১২০ জন। জেনারেল কোর্সে ৩৯০০ আসনের মধ্যে ভর্তি হয়েছেন ২৫০০ পড়ুয়া।” গোবরডাঙা হিন্দু কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, এখানে সব মিলিয়ে ৫৯০০ আসনের মধ্যে ভর্তি হয়েছেন ৪৮০০ জন। কলেজের অধ্যক্ষ হরেকৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, “এখানে অনার্সের ১ হাজার আসনের মধ্যে ভর্তি হয়েছেন ৪০০ আসন। বিজ্ঞান বিষয়ক সাম্মানিক বিষয়গুলিতে ভর্তির সংখ্যা বেশ কম।”
কলেজগুলিতে কেন পড়ুয়া কম ভর্তি হচ্ছেন?
অধ্যক্ষেরা মনে করছেন, কিছু পড়ুয়ার মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়েছে। ফল খারাপ হলেও ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ভর্তি হওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি, জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী অনার্স কোর্স চারবছরের হয়েছে। এর ফলে দরিদ্র পরিবারের অনেক ছেলেমেয়ে আগ্রহ হারাচ্ছে।
বারাসত ১, দেগঙ্গা ও আমডাঙা ব্লকের উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ ছেলেমেয়েদের মধ্যে কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে মেয়েদের হার বেশি। সংসারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে কলেজে ভর্তি না হয়ে নানা ধরনের কাজে যোগ দিচ্ছে ছেলেদের অনেকে। ভিন্ রাজ্যে কাজের সন্ধানে যাওয়া, চাষের কাজে যোগ দেওয়ার হার বেড়েছে ছেলেদের মধ্যে। অনেকের মতে, কলেজ পাশ করেও এলাকায় চাকরি পাননি অনেকে। এই পরিস্থিতিতে কলেজের কোর্স শেষ করার বদলে হাতের কাজ জানা বেশি জরুরি বলে মনে করছেন অনেকে। বেশ কিছু ছেলে অনার্স না পেয়ে ভর্তি হননি।
আমডাঙার কলেজছাত্রী রেহানা পারভিন বলেন, “আমার সঙ্গে পাশ করা অনেকেই আর্থিক কারণে কলেজে ভর্তি হননি। কাজের সুযোগ নেই পড়ে কী হবে?” দেগঙ্গার ছাত্র আরিফুর আলি বলেন, “সরকার মেয়েদের ভাতা দিচ্ছে আর ছেলেদের ঋণ দিচ্ছে। ঋণ নিয়ে পড়ার পরে গরিব পরিবারের ছেলেরা শোধ করবে কী করে? পড়েই বা কী হবে? কেরলে কাজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
বসিরহাট কলেজ সূত্রের খবর, এখানে সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার আসন রয়েছে। ভর্তি হয়েছেন এখনও পর্যন্ত ১৭২০ জন। ভর্তির সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কলেজ কর্তৃপক্ষ ভাবনাচিন্তা করছেন, নতুন করে আবার ছাত্র ভর্তি আবেদন জমা নেওয়ার। অধ্যক্ষ অশোককুমার মণ্ডল জানান, বিজ্ঞান বিষয়ক বিভাগগুলিতে ভর্তির সংখ্যা মাত্র ৫-৬ জন। কলা বিভাগের ছাত্র ভর্তির সংখ্যাও সন্তোষজনক নয়। সব বিভাগেই এক তৃতীয়াংশ পড়ুয়া ভর্তি হয়েছেন। গত কয়েক বছরের তুলনায় ভর্তির সংখ্যা আরও কমেছে। অধ্যক্ষ বলেন, “গত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে, পেশাদারি পড়াশোনার দিকে ঝোঁক বাড়ছে। অন্য দিকে, স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ দুর্নীতির ফলে পড়াশোনায় আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকে। অনার্স নিয়ে পড়ার আগ্রহ হারাচ্ছে অনেকে।” হিঙ্গলগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ শেখ কামালউদ্দিন বলেন, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সংস্কৃত— এই সব বিভাগে পড়ুয়াদের ভর্তির সংখ্যা ২ থেকে ৬ জনের মধ্যে। বাংলা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স নিয়ে পড়ার জন্য ভর্তির সংখ্যা তলানিতে।” একই অবস্থা সন্দেশখালির কালীনগর মহাবিদ্যালয়ে।
কলেজে ভর্তির না হওয়ার প্রধান কারণ ‘দিশাহীন শিক্ষা ব্যবস্থা’ বলে মনে করছেন ডায়মন্ড হারবারের কলেজের কিছু শিক্ষক। পরীক্ষা শেষে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছনোর পথ পাচ্ছেন না পড়ুয়ারা। এ ছাড়া, কলেজে শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৫০ শতাংশে ঠেকেছে। ফলে উপযুক্ত পঠন-পাঠন থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়াশোনায় অনীহা বাড়ছে বলে অনেকের মত। তা ছাড়া, কলেজে ভর্তি হলে সরকারি সাহায্য কী কী মিলবে— তার হিসেব নিকেশ আগেই কষে ফেলছেন পড়ুয়ারা। মথুরাপুরের উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ এক ছাত্রের কথায়, “আমি যে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তাম, তিনি এক জন কৃতী ছাত্র ছিলেন। চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেও কোনও লাভ হয়নি। ওঁকে দেখে পড়াশোনায় আমার আগ্রহ খানিক হারিয়েছে।”
অন্যান্য বছরের তুলনায় ক্যানিং ও বাসন্তীর কলেজে পড়ুয়া ভর্তির সংখ্যা এখনও যথেষ্ট কম। তবে গোসাবায় কলেজে ভর্তির সংখ্যা মোটামুটি ঠিকই আছে বলে কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে। ছাত্র ভর্তির সংখ্যা বেশ কম বাসন্তীর সুকান্ত কলেজে। সেখানে বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইতিহাস ও সংস্কৃত অনার্সে ভর্তির সংখ্যা আশানুরূপ নয় বলে জানালেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। পাস কোর্সে ৭০০ আসন থাকলেও সেখানে এখনও পর্যন্ত ৪৫১ জন পড়ুয়া ভর্তি হয়েছেন। ক্যানিংয়ের বঙ্কিমসর্দার কলেজে এখনও ভর্তি প্রক্রিয়া চলছে।
ভাঙড় মহাবিদ্যালয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ বছর সংস্কৃত, অর্থনীতি ও কমার্সে এক জনও ভর্তি হয়নি। অর্থনীতিতে এক জন ভর্তি হলেও পরে চলে যান। গত বছর কমার্সে ৩ জন ভর্তি হয়েছিলেন। বাংলা অনার্সে প্রায় ৯০টি আসনের মধ্যে ৩০ জন মতো ভর্তি হয়েছেন এখনও পর্যন্ত। তবে ইংরেজি ও ভূগোলে ভর্তির হার মোটামুটি ভাল। দর্শনে ৬০-৬৫টি আসনের মধ্যে ১০-১২ জন ভর্তি হয়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও এডুকেশনে এখনও ৪০ শতাংশ আসন ফাঁকা। জেনারেল কোর্সে (মাল্টি ডিসিপ্লিনারি কোর্স) ৩ হাজার আসনের মধ্যে এখনও পর্যন্ত হাজার দুয়েক ভর্তি হয়েছে।
কলেজ কর্তৃপক্ষের একাংশের মতে, জাতীয় শিক্ষানীতি এখনও কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। তিন বছরের পরিবর্তে চার বছরের অনার্স কোর্স করা হয়েছে। জেনারেল কোর্স দু’বছরের পরিবর্তে তিন বছর করা হয়েছে। পড়াশোনার পিছনে অতিরিক্ত সময় দিয়ে চাকরি মিলবে কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দানা বেঁধেছে ছাত্রছাত্রীদের অনেকের মধ্যে। দীর্ঘ দিন ধরে এসএসসি বা অন্যান্য চাকরির পরীক্ষা না হওয়ায় কিছুটা হতাশা কাজ করছে তাঁদের মধ্যে। তা ছাড়া, নতুন শিক্ষানীতি অনুযায়ী বেশ কিছু বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত এই নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের জন্য কোনও ওয়ার্কশপ বা সেমিনার হয়নি। অনেক শিক্ষকও নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে কার্যত অন্ধকারে। ভাঙড় কলেজের অধ্যক্ষ বীরবিক্রম রায় বলেন, ‘‘কলকাতার কলেজগুলির মতোই আমাদের কলেজে ভর্তির হার খুবই হতাশাজনক। ইংরেজি ও ভূগোলে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী ভর্তি হলেও অন্যান্য বিষয়ে কেউ ভর্তি হতে চাইছেন না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy