Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

চোলাই রুখতে উদ্যোগ পুলিশের, বিকল্প কর্মসংস্থান চাইছেন মানুষ

মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন পুলিশ কর্তা।—নিজস্ব চিত্র।

মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন পুলিশ কর্তা।—নিজস্ব চিত্র।

সীমান্ত মৈত্র
বনগাঁ শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৬ ০১:৩৪
Share: Save:

আদিবাসী অধ্যুষিত মুড়িঘাটার আদিবাসী পাড়া। প্রায় দেড়শো পরিবারের বসবাস। এলাকাটি বনগাঁ থানার গাঁড়াপোতা পঞ্চায়েতের অধীন। বেশির ভাগ মানুষের পেশা বলতে খেতমজুরি, দিনমজুরি। কারও নিজস্ব জমি প্রায় নেই বললেই চলে। দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস। আর্থিক অনটনের কারণে বাড়ির পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও খেতমজুরির কাজ করেন। গ্রামের বহু বাড়ি আজও কাঁচা। অনুন্নয়ের ছাপ স্পষ্ট।

দিনের বেলায় যেমন তেমন। সন্ধ্যার পর থেকেই গ্রামের পরিবেশ সম্পূর্ণ বদলে যায়। শুরু হয়ে যায় চোলাইয়ের রমরমা কারবার। গ্রামের বহু বাড়িতে চোলাই বিক্রি হয়। গ্রামবাসীরা নিজেরা বাড়িতেই চোলাই তৈরি করেন। মূলত বাড়ির মেয়েরাই সেই ব্যবসা সামলান।

গ্রামের পুরুষেরা তো বটেই বাইরে থেকেও চোলাইয়ের টানে বহিরাগতরা এখানে ছুটে আসে। প্লাস্টিকের কাগজে মোড়া চোলাই বিক্রি হয় ১০-২০ টাকায়। সারা দিনের রোজগারের টাকা চোলাইয়ের ঠেকে উড়িয়ে রাত ঘনালে টলমল পায়ে বাড়ি ফেরেন পুরুষরা। তারপরে বাধে অশান্তি।

বহু বছর ধরেই চলছে এই পরিস্থিতি। মহিলাদেরও অনেকে চোলাইয়ের নেশা ধরে ফেলেছেন। নেশায় আসক্ত এক মহিলার কথায়, ‘‘সারা দিন মাঠে হাড়ভাঙা খাটনি। সন্ধ্যায় চোলাই না খেলে শক্তি পাই না।’’

সম্প্রতি বনগাঁ থানার পুলিশ ওই গ্রামেই চোলাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গেলে মহিলারা বাধা দেয়। অশান্তির পরিবেশ তৈরি হয়। তারপরেই পুলিশের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ওই গ্রামে চোলাইয়ের বিরুদ্ধে একটি সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করা হবে।

মুড়িঘাটার মতো আরও কিছু গ্রাম আছে বনগাঁ মহকুমায়, যেখানে চোলাইয়ের কারবার চলছে রমরমিয়ে। ওই সব গ্রাম থেকে চোলাই কারবারিদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করবার আগে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রামে গ্রামে সচেতনতা মূলক প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সম্প্রতি বনগাঁর এসডিপিও হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছেন অনিল রায়। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরে মহকুমার চারটি থানার ওসি আইসিদের নির্দেশ দিয়েছেন, চোলাই মদের কারবার ও চোলাই খাওয়া বন্ধ করতে আরও বেশি করে উদ্যোগী হওয়ার জন্য। সেই মতো চোলাইয়ের বিরুদ্ধে মহকুমা জুড়ে পুলিশি অভিযান শুরু হয়েছে। মহকুমা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত এক মাসে মহকুমায় ২০ জন চোলাই কারবারিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

অভিযান চালাতে গিয়েই কয়েকটি গ্রামকে পুলিশ চিহ্নিত করেছে। সেই সব এলাকায় পুলিশি অভিযান ও আইনি পদক্ষেপ করার আগে এসডিপিও চাইছেন, গ্রামের মানুষকে একবার চোলাই সম্পর্কে সচেতন করতে। সেই মতোই ক’দিন আগে থেকে কাজ শুরু হয়েছে বাগদার আমডোব গ্রামে। পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রামবাসীদের নিয়ে সভা হয়েছে। সেখানে ব্লক প্রশাসন জনপ্রতিনিধি ও আবগারি দফতরের কর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। ওই গ্রামটিও আদিবাসী প্রভাবিত। চোলাই তৈরি হয় গ্রামেই। অনিলবাবু সভায় স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, পুরনো চোলাই যা মজুত আছে, তা ১ মার্চের মধ্যে নষ্ট করে দিতে হবে। তারপরেও কারবার চললে পুলিশ কড়া পদক্ষেপ করবে। স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য কথা দিয়েছেন, তাঁরা আর কারবার চালাবেন না।

শনিবার দুপুরে মুড়িঘাটা গ্রামের আদিবাসী পাড়ায় সভার আয়োজন করা হয়। গ্রামের অনেকেই অবশ্য আসেননি। মাইকে বার বার প্রচার হলেও তেমন সাড়া মেলেনি। যাঁরা এসেছেন, বেশির ভাগই মহিলা। অন্য দিকে, অনিলবাবু ছাড়াও ছিলেন বনগাঁ থানার আইসি নন্দনকুমার পানিগ্রাহী, বিডিও গৌতম মণ্ডল, গাঁড়াপোতা পঞ্চায়েতের প্রধান মধুসূদন বিশ্বাস ও আবগারি দফতরের কর্তারা।

তবে গ্রামের কিছু যুবক এখন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। সংখ্যাটা খুব কম হলেও কয়েকজন সরকারি, বেসরকারি চাকরি করছেন। ওই সব শিক্ষিত যুবকেরা পুলিশকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। নন্দনবাবু বলেন, ‘‘আশা করব চোলাই বন্ধ করতে আর ভবিষ্যতে এই গ্রামে আমাদের সভা করতে হবে না।’’ বিডিও বলেন, ‘‘চোলাইয়ের নেশার ফলে পরিবারগুলি আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’’ গ্রা

ভিড়ের মধ্যে থেকে এক মহিলা এগিয়ে এসে মাইকে বললেন, ‘‘গ্রামের মানুষের এক কাঠাও জমি নেই। এখন রাস্তায় অটো, ম্যাজিক গাড়ি, টোটো চলছে। ফলে ভ্যান চালকেরা কাজ পাচ্ছেন না। পুলিশ-প্রশাসনের কাছে আমাদের অনুরোধ, তাঁরা যেন কাজের ব্যবস্থা করেন।’’ অনিলবাবু গ্রামবাসীদের বলেন, ‘‘চোলাই কারবার কোনও মানুষের পেশা হতে পারে না। ওই কারবার বন্ধ করতে মেয়েদেরই এগিয়ে আসতে হবে।’’ কেউ অসুবিধা করলে পুলিশকে জানানোর পরামর্শ দেন তিনি। ২ মার্চের মধ্যে চোলাইয়ের ঠেক নষ্ট করে দিতে বলেন তিনি।

মহিলাদের কয়েকজন জানালেন, পুলিশের কথা শুনতে আপত্তি নেই। কিন্তু বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করতে হবে।’’ পঞ্চায়েত প্রধান মধুসূদনবাবুর আশ্বাস দিয়েছেন, মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করতে তাদের ঋণ দেওয়া হবে। হাতের কাজের ব্যবস্থা করা হবে। পুরুষদেরও ঋণ দেওয়া হবে বিকল্প পেশা শুরুর জন্য।

এলাকার কয়েকজন শিক্ষিত যুবক অবশ্য জানালেন, তাঁরা অতীতে চোলাই বিক্রি বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। কিন্তু চোলাই কারবারিরা সংখ্যায় বেশি থাকায় উদ্যোগ জলে যায়। কড়া পুলিশি পদক্ষেপই চোলাই বিক্রি বন্ধ করার একমাত্র পথ বলে মনে করেন তাঁরা। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কতটা কাজ হবে, তা নিয়ে সংশয় আছে ওই যুবকদের কারও কারও।

অন্য বিষয়গুলি:

bongaon police initiative brew
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy