সমস্যা: অতিরিক্ত আর্সেনিক থাকায় স্কুলের এই নলকূপ সিল করে দেওয়া হয়েছে। দেগঙ্গায়। ছবি: সজলকুমার চট্টোপাধ্যায়
উত্তর ২৪ পরগনার ২২টি ব্লকেই ভূগর্ভস্থ পানীয় জলে মিলেছে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক। এ দিকে গরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নামছে জলস্তর। ইতিমধ্যেই জলস্তর নেমে যাওয়ায় বারাসত, দেগঙ্গা, গাইঘাটা ও বসিরহাটের মতো অতিরিক্ত আর্সেনিকপ্রবণ এলাকার বেশ কিছু আর্সেনিক মুক্ত নলকূপ অকেজো হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছে স্কুলপড়ুয়ারা। স্কুলের কলগুলি থেকে জল না খাওয়ার জন্য সরকার থেকেই লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে নোটিশ। ভোটের ব্যস্ততার জন্য কল সারানোর সময় মিলছে না প্রশাসনের। এক দিকে পানীয় জলের এই সঙ্কট, অন্য দিকে ভোট চাইতে এসে এই বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের নীরবতা— এই দুইয়ের জেরে ক্ষোভ বাড়ছে এলাকায়।
ভোটের ব্যস্ততার জন্যই আর্সেনিক মুক্ত নলকূপ সারানো যাচ্ছে না, সেই তত্ত্ব অবশ্য মানতে নারাজ প্রশাসন। জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার সঞ্জীব সরকার বলেন, ‘‘জেলা পরিষদ থেকে সরকারি তরফে কিছু অকেজো কলের তালিকা পাঠানো হয়েছে। সেগুলি সারানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কোন কোন স্কুলের জলে সমস্যা রয়েছে, তা খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।’’
‘রাজ্য আর্সেনিক দুষণ প্রতিরোধ কমিটি’-র অবশ্য অভিযোগ, এ সবই আসলে কথার কথা। কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, উত্তর ২৪ পরগনায় ১৪ হাজার মানুষ আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত। ১৫০ জনের মৃত্যুও হয়েছে। ওই কমিটির রাজ্য সম্পাদক অশোক দাস বলেন, ‘‘পরিশুদ্ধ পানীয় জলের মতো মৌলিক অধিকারটুকু আজও পর্যন্ত রাজ্য সরকার নিশ্চিত করতে পারল না।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘মদ খেয়ে মৃত্যু হলে ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ মিলছে, অথচ আর্সেনিক দূষণে মৃতদের ক্ষতিপূরণ তো দূরের কথা, তাঁদের পরিবারের খোঁজখবরও কেউ নিচ্ছে না।’’
বারাসত-টাকি রোড ধরে যেতে গিয়ে দেখা গেল, রাস্তার পাশে মাটির নীচ দিয়ে গিয়েছে ফলতা জল প্রকল্পের পাইপ। নলকূপ খারাপ হয়ে পড়ে থাকায় সেখানে এসে পাইপ কেটে আর্সেনিক মুক্ত জল নিতে আসছেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ। বালতি, বোতল হাতে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পুরুষ ও মহিলারা। আব্দুল রহিম নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘এলাকার সব জলে আর্সেনিক। সরকারই খেতে বারণ করেছে। এ দিকে আর্সেনিক মুক্ত কল খারাপ হয়ে পড়ে রয়েছে।’’ রাইমা পাল বলেন, ‘‘কিনে জল খাওয়ার টাকা নেই। তাই জল নিতে এখানে চলে আসি।’’
দেগঙ্গার আমুলিয়া পঞ্চায়েতে গিয়ে জানা গেল, দিন কয়েক আগেই ওই এলাকার তিনটি স্কুলের জল পরীক্ষা করে অতিমাত্রায় আর্সেনিক মিলেছে। ঝিকুরিয়া অবৈতনিক, বড়গাছিয়া এফ পি এবং রায়পুর এফ পি স্কুলের নলকূপগুলি সিল করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আর্সেনিকমুক্ত নতুন কলের ব্যবস্থা না হওয়ায় পানীয় জলের সংস্থান বন্ধ হয়ে সমস্যায় পড়েছে পড়ুয়ারা। বন্ধ মিড-ডে মিল রান্নাও। শিশুরা বোতলে করে বাড়ি থেকে জল নিয়ে আসছে। ঝিকুরিয়া অবৈতনিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মনিরুজ্জামান বলেন, ‘‘পঞ্চায়েত থেকে এসে পরীক্ষা করে জানাল, স্কুলের কলের জলে বিপজ্জনক মাত্রায় আর্সেনিক মিলেছে। শিশুরা যেন ওই জল না খায়। সঙ্গে সঙ্গেই কল সিল করে দেওয়া হয়। পড়ুয়া ও শিক্ষকদের বাড়ি থেকে জল নিয়ে আসতে বলেছি।’’
একই অবস্থা বড়গাছিয়া এফ পি স্কুল। কলের গায়ে লেখা, ‘এই কলের জল খাওয়া বন্ধ।’ ইমতাজুল হক নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘‘এত দিন পরে হঠাৎ করে টনক নড়েছে। এই কলের জল এত দিন ধরে যে ছেলেমেয়েরা খেল, তাদের শরীরে অতিমাত্রায় আর্সেনিক ঢুকল, তার দায় কে নেবে?’’ তাঁর আরও অভিযোগ, ‘‘১৫ বছর আগে ফলতা থেকে আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল পরিষেবার জন্য দেগঙ্গায় পাইপলাইন আনা হয়েছিল। এত বছর কেটে গেলেও স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা বাড়িতে সেই জলের সংযোগ মেলেনি।’’
বেড়াচাঁপা রথতলায় ১৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সৌরবিদ্যুৎ চালিত ৭০০০ লিটার আর্সেনিকমুক্ত পানীয় জলের কল বসানো হয় এক বছর আগে। দু’মাসের মধ্যে তা বিকল হয়ে যায়। এ দিন শুকদেব বিশ্বাস নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘গ্ৰামের দু’হাজার মানুষ উপকৃত হচ্ছিলেন ওই আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জল পেয়ে। কিন্তু ব্লক থেকে জেলা, এমনকি কলকাতা গিয়েও মেলেনি কল ফের চালু করা যায়নি।’’
জলের লাইনে দাঁড়িয়ে রাসেল মণ্ডল, শ্যামলী দাস ও তরুণ বৈদ্যরা অভিযোগ করে বলেন, ভোটের সময়ে ভোট চাইতে সব দলের প্রার্থীরা এসে নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। কিন্তু আর্সেনিক বা খাবারের জলটা নিয়ে কেউ কোনও কথাই বলছেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy