প্রাপ্তি: হ্যান্ড ট্রাক্টর নিয়ে সমাপ্তি। নিজস্ব চিত্র
মাথায় ও কোমরে বাঁধা গামছা। ডান হাতে লাঠি। এক হাঁটু কাদার মধ্যে কখনও খেতে মই দিচ্ছেন, কখনও বা লাঙল। হাবড়ার আনখোলা গ্রামের বছর তেইশের সমাপ্তি মণ্ডলের জমিচাষ দেখে থমকে দাঁড়ান এলাকার প্রবীণ চাষিরাও। এ বার সেই সমাপ্তিই পেলেন রাজ্য সরকারের ‘কৃষকরত্ন’ সম্মান। তাঁকে দেওয়া হল একটি হ্যান্ড ট্রাক্টরও।
রবিবার স্থানীয় বিডিও অফিসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তাঁকে এই সম্মান তুলে দেওয়া হয়। তাঁকে হ্যান্ড ট্রাক্টর দিলেন রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। হাবড়া-১ বিডিও শুভ্র নন্দী বলেন, ‘‘কৃষি দফতরের পক্ষ থেকে তরুণীকে ট্রাক্টর দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও পঞ্চায়েত সমিতির তরফেও ট্রাক্টর কিনতে আর্থিক সাহায্য করেছেন।’’ দিন কয়েক আগে সমাপ্তি মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ট্রাক্টর দেওয়ার আবেদন করেছিলেন। মন্ত্রী তা দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছিলেন।
সমাপ্তির কথায় ‘‘আগে গরু দিয়ে লাঙল দিতে হত। কখনও ট্রাক্টর ভাড়া করেও চাষ করতাম। এখন নিজের ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করব। এতে চাষের খরচও কম হবে। নিজের জমি চাষ করে ট্রাক্টরটি ভাড়া দিয়েও কিছু টাকাও হাতে আসবে।’’
খেতে কাদামাখা, ঘর্মাক্ত শরীর দেখে বোঝার উপায় নেই সমাপ্তি মণ্ডল নামে ওই তরুণীই গত বছরে ভূগোলে ৪৬ শতাংশ নম্বর পেয়ে অনার্স পাশ করেছেন। সমাপ্তি কী ভাবে শিখলেন চাষবাসের কাজ?
বছর চারেক আগে সমাপ্তির বাবা ভোলানাথ মারা গিয়েছেন। তিনি কৃষক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর আগের আট বছর তিনি কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। ওই সময় পরিবারের হাল ধরেন সমাপ্তির মা অঞ্জলি। তিনিই পারিবারিক জমিতে চাষবাস দেখাশোনা শুরু করেন। নিজেও কৃষি কাজে হাত লাগান। ওই সময় ছোট্ট সমাপ্তি মায়ের সঙ্গে জমিতে যেতেন নিয়মিত। মায়ের কাছ থেকেই সমাপ্তি শিখে নিয়েছিলেন চাষের কৌশল। পরবর্তী সময়ে তিনিই হয়ে উঠেছেন পেশাদার কৃষক।
পরিবার সূত্রের খবর, সমাপ্তিদের প্রায় সাড়ে ৪ একর জমি রয়েছে। সেখানে ধান ফুল আনাজ ও হলুদ চাষ করা হয়। শুধু সমাপ্তি নয়, মা ও তাঁর দিদি দীপাও নিজেদের হাতেই চাষ করেন। দীপাও ভূগোলে স্নাতক।
জমি-পরিচর্যা, লাঙল দেওয়া, মই দেওয়া, বীজতলা তৈরি, ধানের চারা রোপণ সবই তাঁরা যৌথ ভাবে সামলাচ্ছেন। কোন চাষে কোন সার প্রয়োজন, এবং তা কতটা পরিমাণ প্রয়োগ করতে হবে সবই নিজেই ঠিক করেন সমাপ্তি। চাষবাস নিয়ে অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য কৃষিসংক্রান্ত বইপত্তরও পড়েন তিনি। তবে কাজের সুবিধার জন্য মাঝে মধ্যে কয়েকজন শ্রমিক নিতে হয় তাঁকে। নিজেরা চাষবাস করায় চাষের খরচও কম হয়। ফলে আয় কিছুটা বেশি থাকে। নিজেদের পরিবারের জন্য ধান-আনাজ রেখে বাকিরা তাঁরা বিক্রি করে দেন।
সমাপ্তি বলেন, ‘‘চাষবাসের পাশাপাশি চেষ্টা করছি সরকারি চাকরির। তবে চাকরি পেলেও চাষবাসের কাজ কখনও ছাড়ব না। ইচ্ছে রয়েছে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে চাষের উন্নত প্রশিক্ষণ নেওয়ার। তা হলে আরও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষবাস করতে পারব।’’
সমাপ্তি নিজেকে চাষি বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। এবং আন্তরিক ভাবে চান মহিলারা আরও বেশি করে চাষবাসের কাজে যুক্ত হোক। তাঁর কথায়, ‘‘মহিলারা এখন সমাজে সব ধরনের কাজ করছেন। তা হলে কেন তাঁরা কৃষি কাজে পিছিয়ে থাকবেন। বরং মহিলারা চাষ করলে পুরুষদের তুলনায় সফল হওয়ার সম্ভবনা বেশি। কারণ, মেয়েরা যে কোনও কাজ আরও বেশি ভালবাসা দিয়ে করেন।’’ এক মহিলাকে চাষ করতে দেখে এলাকার মানুষের কী প্রতিক্রিয়া ছিল? সমাপ্তির কথায়, ‘‘পেটে খিদে থাকলে কেউ ভাত দিয়ে যাবে না। সৎ পথে থেকে মেয়েরা যদি কৃষিকাজ করে, তা হলে অন্যদের কেন সমস্যা হবে। আমারও কোনও সমস্যা হয়নি।’’
চার দিদির বিয়ে হয়েছে। মা এবং এক দিদিকে নিয়ে তাঁর সংসার। মা অঞ্জলি বলেন, ‘‘দুই মেয়ে যে ভাবে চাষবাস করে সংসারের হাল ধরেছে তাতে আমি ওদের জন্য গর্বিত।’’ সমাপ্তির কথা শুনে গর্বিত খাদ্যমন্ত্রীও। তিনি বলেন, ‘‘সাধারণত স্বামীকে কৃষি কাজে স্ত্রীরা সাহায্য করছেন এমনটা দেখা যায়। তবে একজন কলেজে পড়া তরুণী সংসারের হাল ধরতে চাষবাস করছেন এমনটা দেখা যায় না। মেয়েটি দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। ওকে দেখে আরও মেয়েরা কৃষিকাজে উৎসাহ পাবেন। আমরা সমাপ্তিকে সাহায্য করব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy