পথ অবরোধে সামিল জনতা। ইনসেটে, মৃত সাহিন সাহাজি।
ট্রাক দুর্ঘটনায় শিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পুলিশকে আক্রমণের ঘটনা ঘটল দেগঙ্গায়। দেগঙ্গার চাঁদপুর গ্রামের বাসিন্দা সাহিন সাহাজি (৬) নামে শিশুটি বেড়াচাঁপার একটি বেসরকারি স্কুলে আপার নার্সারিতে পড়ত। ওই দুর্ঘটনায় আহত তার বাবা ব্লক যুব তৃণমূলের সভাপতি ফিরোজউদ্দিনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় স্থানীয় একটি নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে।
সোমবার দেগঙ্গার হাদিপুরে দুর্ঘটনার পরে দেহ উদ্ধার করতে ঘটনাস্থলে গেলে জনতা পুলিশকর্মীদের উপরে চড়াও হয়। গুরুতর আহত হন এএসআই গৌতম বসু, কনস্টেবল দীপক দত্ত এবং সিভিক ভলান্টিয়ার সমর ভদ্র। তাঁদেরও বেড়াচাঁপার নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হয়। খবর পেয়ে দেগঙ্গা থানার ওসি পলাশ চট্টোপাধ্যায় বিশাল বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দেহ উদ্ধার করে ময়না-তদন্তের জন্য বারাসত হাসপাতালে পাঠান। ট্রাকের চালক এবং খালাসিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশকর্মীদের মারধরে অভিযুক্তদের ধরতে পুলিশ তল্লাশি শুরু করেছে। পুলিশি টহল শুরু হয়েছে এলাকায়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকাল ৯টা নাগাদ বাবার মোটরবাইকের পেছনে বসে স্কুলে যাচ্ছিল সাহিন। হাড়োয়া-বেড়াচাঁপা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়ে উল্টো দিক থেকে দ্রুত গতিতে আসা একটি ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হাদিপুরের কাছে হাতিপাড়ায় ফিরোজউদ্দিনের মোটরবাইকে ধাক্কা মারে। ট্রাকের ধাক্কায় রাস্তায় ছিটকে পড়ে সাহিন ও ফিরোজউদ্দিন। তা দেখেও চালক গাড়ি না দাঁড় করিয়ে পালাতে গেলে ট্রাকের পেছনের চাকা সাহিনের মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা। শুরু হয় অবরোধ।
ইতিমধ্যে ট্রাকটি নিয়ে চালক হাড়োয়ার পণ্ডিতপোল থেকে দেগঙ্গার দিকে পালায়। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে দেগঙ্গা বাজারেও জনতা রাস্তা অবরোধ করে। বেকায়দায় পড়ে লরির চালক এবং খালাসি গাড়ি ফেলে সেখানেই একটি দোকানে ঢুকে ভেতর থেকে সাটার ফেলে দেয়। দোকান ঘিরে ফেলে ক্ষুব্ধ জনতা। ট্রাক ভাঙচুর করে তারা। জনতার একাংশ দাবি করে, চালককে তাদের হাতে তুলে না দিলে ট্রাক এবং দোকানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে। গোলমালের আশঙ্কায় বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ করে দেন।
জখম পুলিশ কর্মীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঘটনাস্থল থেকে।
পুলিশ জানায়, খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল দেগঙ্গা বাজারে, অন্য দলটি হাদিপুরে দুর্ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দেয়। দেগঙ্গা বাজারে গিয়ে দলটি স্থানীয় নেতৃত্বের সহায়তায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলে কোনও রকমে পরিস্থিতি শান্ত করে। ট্রাকের চালক ও খালাসিকে সেখান থেকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ও দিকে পুলিশ আসতে দেখে হাদিপুরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জনতা। তাদের অভিযোগ, যে ট্রাকের ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে শিশুটির, তাতে পাচারের গরু নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের প্রশ্রয়েই গরুর ব্যবসার রমরমা। গরু বোঝাই ট্রাক অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলে। তা-ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না পুলিশ। এর কারণে দুর্ঘটনায় সাধারণ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।
এ দিন জনতা দাবি করে, মৃতের পরিবারের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং গরু নিয়ে ট্রাকের যাতায়াত বন্ধ করতে হবে। দেহ উদ্ধারেও বাধা দেয় তারা। পুলিশকর্মীরা বোঝানোর চেষ্টা করলে মারমুখী হয়ে ওঠে বিক্ষোভকারীরা। পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে তারা। লাঠিসোটা নিয়ে আক্রমণ চলে। পুলিশকর্মীদের দৌড়ে পালাতে দেখা যায়। সে সময়ে রাস্তার উপরে ফেলে রাখা কাঠের গুঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়েন কনস্টেবল দীপক দত্ত। জনতার ছোড়া ইটের আঘাতে মাথা ফাটে এএসআই গৌতম বসুর। বাঁশের আঘাতে হাত ভাঙে সিভিক ভলান্টিয়ার সমর ভদ্রের। সে সময়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের চেষ্টায় আহত দুই পুলিশকর্মী একটি মোটরবাইকে উঠে কোনও রকমে এলাকা ছাড়েন। পরে পুলিশের বিশাল বাহিনী এসে দেহ উদ্ধার করে।
ফিরোজ বলেন, “ছেলেকে নিয়ে বেড়াচাঁপার দিকে স্কুলে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ট্রাকটা এসে আমার মোটরবাইকে ধাক্কা মারল।” পুলিশকর্মী গৌতম বসু বলেন, “দেহ উদ্ধারের জন্য গেলে এক দল জনতা আমাদের উপরে চড়াও হয়। ওদের ছোড়া ইটের টুকরো মাথার পেছনে লেগে রক্ত বেরোতে শুরু করে। কোনও রকমে হাত দিয়ে ক্ষত চেপে এলাকা ছাড়ি।”
করিম গাজি, আবু বক্কর মোল্লা, মতিন সাহাজির মতো এলাকার বাসিন্দারা জানান, ছ’চাকার লরিতে বেশি গরু নিয়ে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে ছোট লরির পেছন দিকে টিন জুড়ে বড় করা হয়। চাকার সংখ্যা একই রেখে সাধারণ লরির থেকে অন্তত দেড় গুণ লম্বা ওই বেঢপ যান জোরে চালাতে গিয়ে চালক আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেন না। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। তাঁরা জানান, কেবল বেআইনি ভাবে সীমান্তে পাচারের জন্য গরু নিয়ে যাওয়াই নয়, আইনের তোয়াক্কা না করে ট্রাকের আকার-আয়তন বাড়ানোর ঘটনা পুলিশ-প্রশাসন দেখেও দেখে না। অথচ সামান্য কারণেও সাধারণ মানুষকে ফাইন করে হেনস্থা করা হয়। এ সমস্ত কারণে এলাকার মানুষ এমনিতেই ক্ষুব্ধ ছিলেন। তার উপরে চোখের সামনে একটি শিশুর মৃত্যুতে আরও উত্তেজনা ছড়ায়। ভুক্তভোগী মানুষের অভিযোগ, গরু পাচার তো কমেইনি, বরং সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও বেড়েছে।
এ দিন সন্ধ্যায় সাহিনের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসেন বসিরহাটের সাংসদ ইদ্রিস আলি ও হাড়োয়ার বিধায়ক জুলফিকার আলি মোল্লা। ইদ্রিস বলেন, “খুবই মর্মান্তিক ঘটনা। তবে পুলিশকে আক্রমণ করা যে কোনও পরিস্থিতিতেই অনুচিত কাজ। আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবৈধ ট্রাক চলাচল এবং গরু পাচার নিয়েও প্রশাসনকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।”
—নিজস্ব চিত্র
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy