গত চার বছর বিধানসভার অধিবেশনের কোনও পর্যায়ের কোনও আলোচনায় যোগ দেননি তৃণমূলের ১১৮ জন বিধায়ক। সম্প্রতি এমন তথ্য উঠে এসেছে তৃণমূল পরিষদীয় দলের হাতে। চলতি বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিনই বিধানসভার নওশের আলি কক্ষে বিধায়কদের সঙ্গে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই বৈঠকের আগে তৃণমূল পরিষদীয় দল বিধায়কদের গত চার বছরের কাজকর্ম নিয়ে পর্যালোচনা করেছিল। পর্যালোচনার পর পরিষদীয় দল যে তালিকা তৈরি করেছে, তাতে মোট ১১৮ জন বিধায়কের নাম উঠে এসেছে, যাঁরা গত চার বছরে বিধানসভার কোনও পর্যায়ের কোনও আলোচনায় যোগ দেননি। প্রশ্নোত্তরপর্ব, দৃষ্টি আকর্ষণীপর্ব বা কোনও প্রস্তাব অথবা বিল নিয়ে আলোচনায় যোগ দেননি। অর্থাৎ, তাঁরা নীরব থেকেছেন।
পরিষদীয় বা সংসদীয় রাজনীতিতে এমন উদাহরণ অবশ্য কম নেই। রসিকতা করে সেই অংশকে ‘মূকবধির স্কুল’-এর সদস্যও বলা হয়ে থাকে। একটা সময়ে বাংলার সাংসদদের একটি অংশকে দিল্লির রাজনীতিতে ওই পরিচয়ে পরিচিত হতে হত। এখন অবশ্য পরিস্থিতি ততটা খারাপ নয়। বস্তুত, এখন বাংলার অনেক সাংসদই সংসদের দুই কক্ষে ‘মুখর’। তাঁরা ‘সুবক্তা’ বলেও পরিচিত।
কিন্তু বিধানসভায় পরিস্থিতি তেমন নয়। কারণ, চার-চারটে বছর কেটে গেলেও শাসকদলের এত জন বিধায়ক একসঙ্গে ‘মৌনীবাবা’ হয়ে রয়েছেন, এই ঘটনা দলের কাছেও ‘অস্বস্তিকর’। রাজ্যে তৃণমূলের বিধায়কের মোট সংখ্যা এখন ২২২ জন। তাঁদের মধ্যে ১১৮ জন নীরব থাকার অর্থ অর্ধেকের বেশি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি (বিধানসভায়) মুখ খোলেন না। ২০২৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট। মাত্র এক বছর হাতে রয়েছে বিধায়কদের। এই এক বছরে ওই ১১৮ জন বিধায়ককে বিধানসভার অন্দরে ‘সক্রিয়’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দুই অভিজ্ঞ এবং প্রবীণ নেতা পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় ও বিধানসভায় তৃণমূলের মুখ্যসচেতক নির্মল ঘোষকে।
তবে মৌনী বিধায়কদের ওপর শাস্তির খাঁড়া চাপাতে নারাজ পরিষদীয়মন্ত্রী শোভনদেব। তাঁর কথায়, ‘‘বিধায়কেরা নিষ্ক্রিয় থেকেছেন ঠিকই। তবে তাঁদের শাস্তি না দিয়ে অধিবেশন কক্ষে কী ভাবে সক্রিয় করা যায়, সেই দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের। শুধু বাজেট অধিবেশনই নয়, আগামী দিনেও যাতে আমাদের সব বিধায়ক বিধানসভার প্রতিটি আলোচনাপর্বে যোগ দেন, সেই বিষয়ে আমরা নজর রেখে চলব।’’
বুধবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় বাজেট পেশ হওয়ার পর চার দিনের বিরতি রয়েছে। আগামী সোম-মঙ্গলবার রাজ্যপালের বক্তৃতার ওপর আলোচনা হবে। বুধ-বৃহস্পতিবার বাজেট নিয়ে আলোচনা হবে। এই চার দিনের আলোচনায় বক্তৃতা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ‘নিষ্ক্রিয়’ বিধায়কদের একাংশকে। বুধবার বাজেট বক্তৃতা শেষ হলেও নতুন করে বক্তার তালিকা তৈরি হয় তৃণমূল পরিষদীয় দলের ঘরে। মুখ্যসচেতক নির্মল তাঁর দফতরকে নির্দেশ দেন, যাঁরা এত দিন বিধানসভায় বক্তৃতা করেননি, তাঁদের নাম জমা দেওয়া হোক স্পিকারের দফতরে। তৃণমূল পরিষদীয় দল সূত্রে খবর, সোম এবং মঙ্গলবার রাজ্যপালের ভাষণের উপর যে আলোচনা হবে, তাতে যোগ দেননি এমন কিছু বিধায়ক, যাঁরা সপ্তদশ বিধানসভার সদস্য হয়ে প্রথম বক্তৃতা করবেন অধিবেশনে।
বক্তার তালিকায় রাখা হয়েছে আমতার বিধায়ক সুকান্ত পাল, বসিরহাট দক্ষিণের বিধায়ক সপ্তর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিপালের বিধায়ক করবী মান্না, চাঁপদানির বিধায়ক অরিন্দম গুঁইদের। সদ্য উপনির্বাচনে জয়ী বিধায়কদেরও এই বিতর্কে বক্তৃতা করতে হবে বলে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। সেই তালিকায় নাম রয়েছে মেদিনীপুরের বিধায়ক সুজয় হাজরা, নৈহাটির বিধায়ক সনৎ দে, তালড্যাংরার বিধায়ক ফাল্গুনী সিংহবাবু, হাড়োয়ার বিধায়ক শেখ রবিউল ইসলাম এবং সিতাইয়ের বিধায়ক সঙ্গীতা রায়ের।
আরও পড়ুন:
২০১৬ সাল থেকে বর্ধমান উত্তরের তৃণমূল বিধায়ক নিশীথ মালিককেও খুব ‘সক্রিয়’ হতে দেখা যায়নি বিধানসভার বিতর্কে। দু’বারের বিধায়ক হলেও নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে তাঁর যুক্তি, ‘‘আমি কোনও কিছু বলার আগেই আমার বিধানসভার সব কাজ হয়ে যায়। তাই বলার মতো কিছু থাকে না। তাই বিধানসভার কোনও বিতর্কে যোগ না দিলেও বিধায়ক হিসেবে কাজ করতে অসুবিধা হয় না।’’
তবে তৃণমূল পরিষদীয় দলে ‘ব্যতিক্রম’ও আছে। এমন এক জন তৃণমূল বিধায়কও আছেন, যিনি প্রথম বার নির্বাচিত হয়েই গুরুত্বপূর্ণ সব আলোচনায় যোগ দিয়েছেন গত চার বছরে। তিনি মুর্শিদাবাদের লালগোলার বিধায়ক মহম্মদ আলি। তিনি ‘সক্রিয়’ হওয়ায় বহু ক্ষেত্রে তৃণমূল পরিষদীয় দল তাঁকে সুযোগও দিয়েছে বলার। রাজ্যপালের ভাষণের উপর আলোচনাতেও নতুনদের সঙ্গে তাঁকে জায়গা দেওয়া হয়েছে।