যে মাস্ক এক কালে হাসাত, এক বছরে তা হয়ে দাঁড়াল ফ্যাশনের দ্রব্য।
১৭ মার্চ, ২০২০। প্রথম কোভিড ঢুকল বাংলায়। শুরু হল ভয়, আতঙ্ক, পরপর মৃত্যু। সব বর্ষপূর্তি সুখের হয় না। তবু গত এক বছরের ছন্দপতন ফিরে দেখল আনন্দবাজার ডিজিটাল।
সেই আমলাপুত্র এখন কোথায়? তিনি কি এখন মাস্ক পরেন? গত বছরের ১৭ মার্চ সেই যে মাস্ক ঢুকে পড়ল শহরে (বলা ভাল, মাস্ক পরতে বাধ্য হল শহর), সেই তিনি মাস্ক পরলে কি বাকিদের এখন মুখ ঢেকে চলার প্রয়োজন হত? কে জানে!
এক কালে মাস্ক ছিল বিলাসিতা। শ্বাসকষ্টের কারণে তা ব্যবহার করতে হলে আশপাশের লোকের টিপ্পনিও শুনতে হত। মাস্ক মানে যে মুখোশ! মুখোশ ব্যবহার কি আর সরল অভ্যাস? ফলে গত বছরের ১৭ মার্চের আগে পর্যন্ত তা হাসিঠাট্টার বস্তুই ছিল। অন্তত এ শহরে। এ রাজ্যে। বিলেতফেরত আমলাপুত্রের সঙ্গে করোনা ঢুকল বাংলায়। কোভিড ১৯ ভাইরাসের ভয় মুখ ঢাকতে বাধ্য হল শহর। বাধ্য হল বাংলা। এককালের সেই ঠাট্টা হয়ে দাঁড়াল বাধ্যতা। তা ঘিরে অস্বস্তি এল বটে। তবে অভ্যাসেও পরিণত হল। সাবধান হওয়ার সেই অভ্যাস ভাইরাসের সঙ্গে লড়াইয়ের ইচ্ছে এক এক মার্চ থেকে অন্য মার্চের মধ্যে তৈরি করে ফেলল একটা গোটা শিল্প। মাস্ক-শিল্প। যে মাস্ক এক কালে হাসাত, এক বছরে তা হয়ে দাঁড়াল ফ্যাশনের দ্রব্য। শৌখিনতার অভিজ্ঞানও বটে।
মধ্য-মার্চের অনেক গুরুত্ব আছে ইতিহাসে। তবে এ রাজ্যে মার্চ মাসের গুরুত্ব এখন আলাদা। মুখোশের আড়াল থেকে মারণ ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার অভ্যাস রপ্ত করিয়েছে মধ্য-মার্চ। প্রকাশ্যে গোটা মুখ দেখানো দস্তুর নয় আর। এক বছর পরেও নয়।
এক মার্চ থেকে অন্য মার্চ— ধাপে ধাপে বদলে গিয়েছে অভ্যাস। এক কালে দ্বিচারিতার রূপক হিসেবেই অহরহ ব্যবহৃত হত ‘মুখোশ’ শব্দটা। এক কবি লিখেছিলেন, মুখোশ মিথ্যা দেখায়। মুখ ঢেকে দেয়। চোখের ভঙ্গিও বদলে দেয়। ঠিক একটা বছর আগে এক শহরবাসীর সঙ্গে ঘটেছিল অদৃশ্য ভাইরাসের প্রবেশ। যা বদলে দিয়ে গিয়েছে শহরের চেহারাই। রূপকের সেই ‘বদ অভ্যাস’ আক্ষরিক অর্থেই রপ্ত করতে বাধ্য হল শহর। মুখোশই এখন ভরসা জোগায়। সুস্থ রাখার আশ্বাস দেয়।
এক কালে সুশিক্ষার অঙ্গ ছিল মুখোশ দূরে রাখা। মুখ-মুখোশের মধ্যে পার্থক্য বোঝা। রূপকার্থে। অতিমারি সেই মুখোশকে আক্ষরিক অর্থে এনে দিল প্রয়োজনের তালিকায়। মুখোশ-নির্ভর সময়ে মাস্ক এখন ফ্যাশনও। সুন্দর মাস্ক। অসুন্দর মাস্ক। বিয়েবাড়ির মাস্ক। সেমিনারের মাস্ক। একবছর আগের ১৭ মার্চ শিখিয়েছিল, বেপরোয়া ভাবে মুখোশেই সাজতে হবে নিজেদের। দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে। প্রকাশ্যেই এখন আড়ালে থাকায় বিশ্বাস রাখার পালা। একবছর পরের ১৭ মার্চ দেখাচ্ছে, অন্যে না রাখতে চাইলেও মাস্ক পরতে বাধ্য করাই সভ্যতা।
শুধু তো একটা মুখোশ আর স্যানিটাইজার নয়। এক বছর ধরে চেনানো নতুন অভ্যাস কত পুরনোকে ‘অস্বাভাবিক’ বলে দেগে দিল! মাস্ক পরে বেরোনো এখন ‘নয়া স্বাভাবিক’। কিন্তু তার সঙ্গে বাঙালির হাসিও ঢেকে গেল! একে-অপরকে দেখে স্বাভাবিক সৌজন্যের ধারণা বদলাতে হল। এখন আর হাসিবিনিময় ভদ্রতার অঙ্গ নয়। হাসি তো দূরে থাক, মাস্কের আড়ালে কথাও চাপা পড়ে যায় অনেক সময়ে। মৃদু স্বরে কথা বলা এক কালে তো ভদ্রতাই ছিল? মাস্ক গলা চড়াতে বাধ্য করল। তবু বেঁচে থাকার জন্য লড়াই। বেঁচে থাকা মানে তবে কি শুধুই শ্বাস নেওয়া? শ্বাস-প্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় পিছনে ফেলে দেওয়া সমস্ত সৌজন্যের বোধ?
কিন্তু মাস্ক পরে শ্বাস নিতেও বাধা পড়ে মাঝেমাঝে। তখন আড়ালে গিয়ে মুখোশ খোলার পালা। আসল মুখটা বার করার সুযোগটুকু সন্ধান। তবু সেই মুখোশই ভরসা জোগায় আবার শ্বাস নেওয়ার। আলগা আশ্বাস দেয়, পরের ভোরটা দেখতে পাওয়ার। তাই মুখে মুখোশটুকু ঝুলিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। মুখের বদলে মাস্কটাই আরও সুন্দর করার ইচ্ছা। একবছর আগের ১৭ মার্চ আর একবছর পরের ১৭ মার্চ আয়নায় দেখে একে অপরকে। আর বোধহয় অস্ফূটে প্রশ্ন করে— সেই আমলাপুত্র কি মাস্ক পরেন এখন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy