Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
প্রশ্নের মুখে পুলিশের সাহস

হাতের পাঁচকে ধরে মান বাঁচানোর চেষ্টা

এমন সূত্র চাই যাতে বেড়াল মরে, কিন্তু ডান্ডাও না ভাঙে। সেটা করতে গিয়েই আলিপুর থানায় ভাঙচুরের অভিযোগে বেছে বেছে সেই পাঁচ জনকে পাকড়াও করল পুলিশ, যাদের কারও বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে, কারও বা ৫০ কিলোমিটার। মুখে বলা হল, সিসিটিভি ফুটেজ দেখেই এদের চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশের একটি সূত্রের বক্তব্য, শাসক দলের সমর্থকদের হামলা বলে বড় পদক্ষেপ করতে সাহস পায়নি তারা। অথচ এই নিয়ে দিনভর সর্বত্র হট্টগোলের ফলে ব্যবস্থা একটা নিতে হতোই।

আলিপুর কোর্টে অভিযুক্তরা। শনিবার।  —নিজস্ব চিত্র।

আলিপুর কোর্টে অভিযুক্তরা। শনিবার। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৪ ০২:৩৭
Share: Save:

এমন সূত্র চাই যাতে বেড়াল মরে, কিন্তু ডান্ডাও না ভাঙে।

সেটা করতে গিয়েই আলিপুর থানায় ভাঙচুরের অভিযোগে বেছে বেছে সেই পাঁচ জনকে পাকড়াও করল পুলিশ, যাদের কারও বাড়ি ঘটনাস্থল থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে, কারও বা ৫০ কিলোমিটার। মুখে বলা হল, সিসিটিভি ফুটেজ দেখেই এদের চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশের একটি সূত্রের বক্তব্য, শাসক দলের সমর্থকদের হামলা বলে বড় পদক্ষেপ করতে সাহস পায়নি তারা। অথচ এই নিয়ে দিনভর সর্বত্র হট্টগোলের ফলে ব্যবস্থা একটা নিতে হতোই। তাই ওই পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের ওই সূত্রই জানাচ্ছে, এরা কেউই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয়। তাই পুলিশ হেফাজতে না-চেয়ে জেলহাজতের আর্জি জানানো হয়। আদালত সেই মতো তিন দিনের জেলহাজতের নির্দেশ দিয়েছে তাদের। এর ফলে পাঁচ জন সহজেই জামিন পেতে পারে বলেও মনে করে পুলিশের ওই সূত্রটি।

প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে মূল হামলাকারীদের কেন পাকড়াও করল না পুলিশ? আসল অপরাধীরা কেন এখনও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

পুলিশের একাংশের বক্তব্য, শাসক দলের একটি মহলের আপত্তিতে প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতার করার ব্যাপারে পুলিশের অসুবিধা ছিল। কিন্তু খোদ শহরের বুকে থানা আক্রমণের ঘটনা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সর্বস্তরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য পুলিশের কিছু করার দরকার ছিল। তাই প্রশাসনের মুখরক্ষায় পাঁচ জনকে ধরা হয়। এই বক্তব্য তৃণমূলের কোনও কোনও সমর্থকেরও।

পুরো ঘটনার পিছনে মূল মাথাটি যাঁর বলে অভিযোগ করা হচ্ছে, ফিরহাদ হাকিম ঘনিষ্ঠ সেই প্রতাপ সাহাকে জালে ফেলার ব্যাপারেও সমস্যা রয়েছে। পুলিশ সূত্রেই বলা হচ্ছে, প্রতাপ ঘটনাস্থলে ছিলেন না। তিনি থানায় যাননি। অথচ তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই হামলার ঘটনাটি ঘটেছে। তাঁর সেই ভূমিকা সম্পর্কে যাঁরা বলতে পারতেন, শুক্রবারের সেই হামলাকারীদের কাউকেই এ দিন ধরা হয়নি। বিধান রায় কলোনি তৃণমূলের তালুক। সেখানে ঢোকার সাহসই দেখাতে পারেনি থানায় টেবিলের তলায় ঢুকে মাথা বাঁচানো পুলিশ।

মহম্মদ পাপ্পু, শেখ রেজ্জাক, মহম্মদ শাকিল, সৌমেন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ছোট্টু সাউ নামে যে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ, তাদের মধ্যে পাপ্পু, রেজ্জাক ও শাকিল বন্দর এলাকায় মেটিয়াবুরুজ-রাজাবাগানের বাসিন্দা। সৌমেনের বাড়ি মথুরাপুরে (দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর কি না, অ্যারেস্ট মেমোয় তা পরিষ্কার করে লেখেনি পুলিশ)। ছোট্টুর বাড়ি ভবানীপুরের বেলতলা রোডে। ধৃতদের পরিবারের অভিযোগ, স্থানীয় লোকজনকে আড়াল করতেই এই পাঁচ জনকে ফাঁসানো হয়েছে।

ধৃতদের গায়ে দাগি অপরাধীর তকমা লাগানোর মতো কোনও প্রমাণও দিতে পারেনি পুলিশ। এই যুবকেরা কেন আলিপুর থানায় হামলা করল, তার কোনও নির্দিষ্ট কারণও জানাতে পারেনি তারা। এমনকী, গ্রেফতারের ব্যাপারে যুক্তি দিতে গিয়ে যে সিসিটিভি ফুটেজের কথা পুলিশ বলেছে, আদালতে সেই ফুটেজ কিন্তু তারা জমা দিতে পারেনিা। অভিযুক্তদের আইনজীবী অর্ঘ্য গোস্বামী বলেন, “পুলিশের সিসিটিভি ফুটেজে ধৃতদের ছবি নেই।” প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কি ওই যুবকেরা আলিপুর থানায় আদৌ এসেছিল? কোনও প্রমাণ আদালতে দাখিল করতে পারেনি পুলিশ।

তবে ভাঙচুরে ‘বহিরাগতরাই’ জড়িত, এমন তত্ত্ব খাড়া করেছেন পুরমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ প্রতাপ সাহা। তিনি বলেছেন, “বহিরাগতরাই গোলমাল করেছে। এটা সিপিএমের চক্রান্ত।” তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় স্থানীয় এক কংগ্রেস নেতার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, “যিনি তৃণমূলের বিরুদ্ধে গোলমাল বাধানোর অভিযোগ করছেন, তাঁকেই তো পুলিশ খুঁজছে।”

শাসক দলের এই তত্ত্ব নিয়ে পাল্টা কটাক্ষ করেছেন বিরোধী নেতারা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম বলেন, “ববি নিশ্চয়ই জানতেন, কারা আলিপুর থানা আক্রমণ করেছে। তাই শুক্রবার বলেছিলেন, স্থানীয় কেউ থানায় ভাঙচুর, গণ্ডগোল করেনি।” কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, “মন্ত্রী আগেই বলেছিলেন, স্থানীয় কেউ আলিপুর থানায় হামলা করেনি। কিন্তু বাইরের লোক এসে কেন আলিপুর থানা আক্রমণ করতে যাবে?”

সাধারণত, এই সব ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের হেফাজতে নেয় পুলিশ। তাদের জেরা করে বাকি অভিযুক্তদের গ্রেফতার ও তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ দিন আলিপুর থানার পক্ষ থেকে ধৃতদের জেল হাজতে পাঠানোর আর্জি জানানো হয়েছিল। আদালত অভিযুক্তদের ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত জেল হেফাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। তা হলে ধৃতদের জেরা করে বাকি অভিযুক্তদের কী ভাবে গ্রেফতার করা হবে? এর কোনও উত্তর মেলেনি পুলিশের থেকে।

যাদের ধরা হল, তারা কারা?

এ দিন রাজাবাগানের বাসিন্দা পাপ্পু ও শাকিলের পরিবার জানিয়েছে, দু’জনেই এলাকায় সেলাইয়ের কাজ করে। শুক্রবার সেই কাজই করেছে। বিকেলে খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেটে সিডি কিনতে যায়। সেখান থেকেই ধরা হয় তাদের। বেলতলা রোডের বাসিন্দা ছোট্টু সাউয়ের মা যমুনা সাউ বলেন, “আমার ছেলে গোলমালে যায়নি। পুলিশ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেলে কী করব!” মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দা পাপ্পু এলাকায় রিকশা চালান। তাঁর বাড়ির লোকেরা বিহারে থাকেন। তাঁকে কোথা থেকে, কী ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে তা খোলসা করতে নারাজ পুলিশ। আইনজীবীদের অভিযোগ, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে ধৃতদের অ্যারেস্ট মেমোতে স্পষ্ট করে কারও ঠিকানা লেখা হয়নি। সকলের ক্ষেত্রেই গ্রেফতারের জায়গা হিসেবে দেখানো হয়েছে আলিপুরের ওই কলোনি সংলগ্ন রাস্তা।

গ্রেফতারের খবর পেয়ে শাকিল-রেজ্জাকের পরিবারকে নিয়ে থানায় হাজির হন রাজাবাগানের বাসিন্দা শামসের আলি। তিনি বলেন, “পুলিশ বলল, আপনাদের লোকেরা বড় ঝামেলায় ফেঁসেছে। কিন্তু কেন ফাঁসল, কী ভাবে ফাঁসল, তার উত্তর দেয়নি।” শাকিলের স্ত্রী সাজদা খাতুন বলছেন, “আমার পাঁচ ছেলেমেয়ে। পরিবারের পয়সা জোগানোর লোকটাকেই পুলিশ ফাঁসাল। এখন আমরা খাবটা কী?”

অভিযুক্তদের কৌঁসুলিরা আলিপুর আদালতের মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট সঞ্জীব দারুকার এজলাসে পুলিশের বিরুদ্ধে ফাঁসানোর অভিযোগ করেছেন। পুলিশ কী ভাবে ভুয়ো অভিযোগ দায়ের করে নির্দোষদের গ্রেফতার করেছে, বিচারকের কাছে তা খতিয়ে দেখায় আর্জিও জানান তাঁরা। এরই মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়িয়েছেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তিনি শুক্রবার বলেন, “আমি খোঁজ নিয়েছি। ওসি বলছেন, সে রকম কিছু হয়নি।” শনিবার হাওড়ার শরৎ সদনে তিনি বলেছেন, “পুলিশ আক্রান্ত হয়নি। সংবাদমাধ্যম মিথ্যা প্রচার করছে।” তা হলে পুলিশ পাঁচ জনকে ধরল কেন? মন্ত্রী এর উত্তর এড়িয়েছেন। মুখে কুলুপ কলকাতা পুলিশের কর্তাদেরও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE