শিবপ্রসাদ মুস্তাফি ছিটমহলে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের দলের নাটক।—নিজস্ব চিত্র।
ব্রাত্য দশা কি ঘুচতে চলেছে যুগ যুগ ধরে অবহেলার অন্ধকারে ডুবে থাকা ছিটমহলগুলির?
ভারত ভূখণ্ডের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৫১টি বাংলাদেশের ছিটমহলের একটি শিবপ্রসাদ মুস্তাফি ছিটমহল। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে আদপে কোনও রকম সম্পর্কই নেই শিবপ্রসাদ মুস্তাফি বা অন্য ৫০টি ছিটমহলের বাসিন্দাদের কারওর। সেই ধাদ্ধাড়া শিবপ্রসাদ মুস্তাফি ছিটমহলে বৃহস্পতিবারই প্রথম বয়ে এল বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের সংস্কৃতি-বিনোদনের এক ঝলক তাজা বাতাস। মঞ্চ বেঁধে পূর্ণাঙ্গ নাটক অভিনয় করলেন বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার নামকরা কিশোর নাট্য অ্যাকাডেমির শিল্পীরা। ছিটমহলের ইতিহাসে এই প্রথম। শিবপ্রসাদ মুস্তাফির বাসিন্দা ঈশ্বর দেবনাথের মুখের হাসি আর মুছছে না। জানালেন তাঁর বছর পঞ্চাশ বয়স, ছিটমহলে এ ভাবে মঞ্চ বেঁধে নাটক হচ্ছে, কস্মিন কালেও দেখেননি। আর বাংলাদেশ থেকে আসা কোনও দলের নাটক তো নয়ই। স্বভাবতই উপচে পড়া ভিড়। আশপাশের ছিটমহল থেকেও হুড়োহুড়ি করে মেয়ে-বুড়ো, কচি-কাঁচারা এসেছেন ‘অসুরবধ পালা’ দেখতে।
“ভিড় তো হবেই। কোচবিহার জেলার উপকণ্ঠে এই সব ছিটমহলের হাজার হাজার মানুষের কী আছে জীবনে?” বলছিলেন ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির নেতা দীপ্তিমান সেনগুপ্ত। তাঁর কথায়, “নাগরিকত্বহীন অন্ধকার জীবনে এই প্রথম সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের আলো দেখলেন সেখানকার বাসিন্দারা।” এই ছিটমহলগুলিতে সিনেমা হল তো দূরের কথা, ভিডিও হল পর্যন্ত নেই। ইস্কুল-হাসপাতাল, বিদ্যুৎ পরিষেবাই নেই। কিন্তু সব থেকে বড় সমস্যা হল, ছিটমহলগুলির বাসিন্দাদের নাগরিকত্বের পরিচয়পত্রটুকুও নেই। সেখানে সংস্কৃতি চর্চা, নাট্যমঞ্চ সে সব তো সোনার হরিণ!
সকাল থেকেই ছিল উৎসাহের জোয়ার। কালীপুজো তো ফি বছর হয়। এ বার সেই দিনে এ যেন এক নতুন উৎসব! বাংলাদেশের শিল্পীদের স্বাগত জানাতে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিলেন এই ছিটমহলের ৬৮টি পরিবার। তাঁদের যাতায়াতের রাস্তার ধারে জ্বেলে রাখা হয়েছিল ১১টি করে প্রদীপ।
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি সূত্রেই জানা গিয়েছে, বুধবার রহিম আবদুল রহিমের নেতৃত্বে ওই নাট্যদলের শিল্পীরা চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত দিয়ে এ দেশে আসেন। বুধবার রাতে মেখলিগঞ্জে একটি কালীপুজোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ওই নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। বৃহস্পতিবার সকালে নাট্যদলটি দিনহাটা পৌঁছয়। সন্ধ্যে নাগাদ শিবপ্রসাদ মুস্তাফি ছিটমহলে পৌঁছন তাঁরা। সেখানে মহিলা পরিচালিত একটি কালীপুজোর মন্ডপ লাগোয়া চত্বরেই মঞ্চ বাঁধা হয়। অভিনীত হয় তাঁদের নাটক।
রহিম আবদুল রহিমই নাটকের লেখক ও নির্দেশক। গণেশের চরিত্রে অভিনয় করেন হাবিদুল ইসলাম, কার্তিক সুব্রত বণিক, অসুর হয়েছিলেন মনির হোসেন, মা মনসা আলমগির হোসেন আর দুর্গার চরিত্রে মাসুদ রানা। তাঁর সকলেই বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের বাসিন্দা। রহিম আবদুল রহিম জানান, ২০১২ সালে দিল্লিতে আন্তর্জাতিক শিশুনাট্য উৎসবে এই নাটকটি খুব প্রশংসা কুড়িয়েছে। ছিটমহলের কথা শুনলেও সেখান থেকে ওই নাটক মঞ্চস্থ করার আমন্ত্রণ আসবে, কখনও ভাবেননি।
তা বলে ছিটমহলে বাসিন্দাদের বিনোদন বলতে কি কিছুই নেই? এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে মাঝে মাঝে কবাডি, ভলিবল, হাডুডু প্রতিযোগিতা হয়। বিশ্বকাপের সময় অবশ্য ফুটবলে মজেছিলেন তাঁরা। জেনারেটর ভাড়া করে অস্থায়ী ভাবে ডিস বসিয়ে খেলা দেখানোর ব্যবস্থা হয়। জার্মানির বাসিন্দা এক মহিলা ছিটমহলের এক শিশুর পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে আগ্রহ জানানোর প্রতিদান দিতে জার্মানিকেই সমর্থন করছিলেন ছিটমহলের অধিবাসীরা। ছিটমহল এখনও রেডিও যুগেই পড়ে। সকাল থেকে কাজের ফাঁকে সংবাদ থেকে সংগীতানুষ্ঠান, রেডিওয় মজে থাকেন অনেকেই।
দীপাবলির রাত কিন্তু ছিল অন্য রকম। ভাড়া করে আনা ইনভার্টারের আলোয় তাই ভরে ওঠে ওই মঞ্চের সামনের এলাকাটুকু। সেখানেই ‘অসুরবধ’ করে গেলেন বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে আসা নাট্যকর্মীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy