পৃথক পর্যটন নীতি তৈরি করে কেরল-মহারাষ্ট্র-গুজরাত-রাজস্থান তো বটেই, অন্ধ্র-বিহারের মতো রাজ্যও পশ্চিমবঙ্গকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। বলছেন রাজ্য প্রশাসনেরই কিছু কর্তা। প্রশাসনের ওই অংশের অভিযোগ, পর্যটন তো পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকাতেই নেই! পরিকাঠামো না-গড়ে পর্যটনের বস্তাপচা ধ্যানধারণা নিয়েই এখন তাতে লগ্নি টানতে উৎসাহ ভাতার প্রলেপ দেওয়ার উদ্যোগ চলছে।
জমি তৈরি না-করে সার ঢালার অভিযোগ কেন? পর্যটনে ঠিক কী করতে চাইছে রাজ্য সরকার?
‘কী করতে চাইছে’র তুলনায় বড় হয়ে উঠছে ‘কী করছে না’ প্রশ্নটি। বড় শিল্পে সাড়া নেই। ছোট বা মাঝারি শিল্পেও উল্লেখযোগ্য লগ্নি আসেনি। এই অবস্থায় ক্ষমতায় আসার সাড়ে তিন বছর পরে এ বার পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ টানতে ইনসেন্টিভ স্কিম বা ‘উৎসাহ ভাতা’ চালু করতে চলেছে তৃণমূল সরকার। পর্যটন দফতর সূত্রের খবর, উৎসাহ ভাতা প্রকল্পে ‘বিশেষ’ এলাকায় এক কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লগ্নি করলে সরকার ২৫ শতাংশ ভর্তুকি দেবে। সেই সঙ্গে ব্যাঙ্ক বা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের সুদের উপরে ভর্তুকি মিলবে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত। বিশেষ এলাকায় অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে লগ্নি করলে ভ্যাট বা যুক্তমূল্য করের পুরোটাই মকুব করা হবে।
আর ‘কী করছে না’র তালিকায় আছে লাগসই নিজস্ব পর্যটন নীতি এবং প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো। নবান্নেরই খবর, জঙ্গলমহল এবং সুন্দরবনকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে রাজ্য সরকার নতুন যে ‘ট্যুরিজম ইনসেন্টিভ পলিসি’ বা নয়া ‘পর্যটন উৎসাহ নীতি’ তৈরি করেছে, তার সঙ্গে বাম আমলের পর্যটন-নীতির বিশেষ ফারাক নেই। উৎসাহ ভাতার বন্দোবস্ত করতে গিয়েও নতুন মোড়কে বাম আমলের দাওয়াই বাতলেছেন সরকারি কর্তারা। পর্যটনে লগ্নি টানতে ২০০৮ সালে ‘উৎসাহ ভাতা’ ঘোষণা করেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। তৃণমূল সরকারের কর্তারা কার্যত সেটাকেই নতুন করে তুলে ধরেছেন। বাড়তি বলতে আগে রাজ্যের পর্যটন এলাকাকে চার ভাগ করা হয়েছিল। সেটা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। আর সুন্দরবন ও জঙ্গলমহলকে ‘বিশেষ এলাকা’ ঘোষণা করে বাড়তি কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যেমন, ওই দুই অঞ্চলে বিনিয়োগ করলে ভর্তুকি ছাড়াও মিলবে আর্থিক ছাড় এবং বিদ্যুৎ শুল্কের উপরে কিছু বাড়তি ছাড়। অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস-এ বিনিয়োগ করলেও বাড়তি সুবিধা মিলবে।
পরিকাঠামোয় নজর না-দিয়ে পুরনো নীতিরই চর্বিতচর্বণে কী লাভ হবে, সেই প্রশ্ন তো উঠছেই। সংশয় দেখা দিয়েছে পর্যটন শিল্পে রাজ্যের সদিচ্ছা নিয়েও। প্রশাসনের একাংশের প্রশ্ন, শুধু উৎসাহ ভাতা দিয়ে কি লগ্নি ও পর্যটক আকর্ষণ করা সম্ভব?
শুধু প্রশাসনের একাংশের প্রশ্ন বা কটাক্ষ নয়। সমালোচনায় মুখর হয়েছেন সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পর্যটন সংস্থার কর্তারাও। তাঁরা মনে করেন, এ রাজ্যে পর্যটন শিল্পের ভাবনাই এখনও সাবালক হয়নি। এখানে পর্যটন বলতে সমুদ্র-পাহাড়-অরণ্য বা কোনও ঐতিহাসিক স্থানকে কেন্দ্র করে কিছু হোটেল বা রিসর্ট গজিয়ে ওঠা। তার সঙ্গে বড়জোর স্থানীয় প্রশাসনের তরফে রাস্তা-জল-আলোর ব্যবস্থা করে দেওয়া।
পর্যটন শিল্পে সুদিন আনতে ঠিক কী কী করা দরকার?
“প্রতিটি পর্যটন কেন্দ্রের নিজস্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থাকা দরকার। সেই সঙ্গে প্রয়োজন ছুটি কাটানোর এবং পর্যাপ্ত বিনোদনের ব্যবস্থা। যেমন, হেলিপ্যাড, গল্ফ কোর্স, স্পা, যোগা সেন্টার, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস ইত্যাদি। সেই লক্ষ্যে পর্যটন নীতি তৈরি করতে হবে,” বলছেন পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত এক শিল্পপতি। তাঁর অভিযোগ, এ রাজ্যে পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা, গল্ফ কোর্স, হেলিপ্যাড করার মতো জমি কী ভাবে মিলবে, তার স্পষ্ট দিশা নেই পর্যটন নীতিতে।
একই কথা বলছেন রাজ্যের ট্র্যাভেল এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক প্রবীর সিংহরায়। তাঁর কথায়, “সুন্দরবনে এখনও বহু জায়গায় জেটি নেই। রাস্তার হালও তথৈবচ। সেখানে শিল্প হবে কী ভাবে?”
প্রবীরবাবুর অভিযোগ, সরকার পর্যটন সংক্রান্ত নীতি তৈরির আগে বিশেষজ্ঞদের কোনও পরামর্শই নেয়নি। সরকারের কাছে বারবার প্রস্তাব পাঠিয়েছে ট্র্যাভেল এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। কিন্তু সেগুলোর ব্যাপারে মাথা ঘামানো হয়নি।
পাহাড়, সমুদ্র, অরণ্যের উদার ঐশ্বর্যে যে-রাজ্য সমৃদ্ধ, সেখানে পর্যটন শিল্পের সাফল্যের জন্য শুধু সরকারের সদিচ্ছা আর একটি সমর্থ নীতি প্রয়োজন বলে সরকারি-বেসরকারি কর্তাদের অভিমত। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তার দাবি, উৎসাহ ভাতা নয়, পৃথক পর্যটন নীতি তৈরি করে এগিয়ে গিয়েছে কেরল, গুজরাত, রাজস্থান, এমনকী বিহারও। “বিহার ও বুদ্ধগয়াকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সেখানে বিমানবন্দর-সহ নানা পরিষেবা চালু করা হয়েছে। ফলে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যাও দিন-দিন বাড়ছে,” দাবি ওই কর্তার।
প্রশাসনের একাংশের খেদ, বাংলায় তেমন কোনও চেষ্টাই নেই। সরকার গড়ার সূচনায় যা বলা হয়েছিল, সেই রেকর্ড শোনানো হচ্ছে এখনও। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
কী বলছে সরকার?
“পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগ আনতে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করবে সরকার,” আশ্বাস দিয়েছেন রাজ্যের পর্যটনমন্ত্রী ব্রাত্য বসু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy