Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

পেল্লায় শিলার বৃষ্টিতে শস্য তছনছ, ৮ ময়ূরের প্রাণান্ত

শনিবারের রাত তখন বারোটা পেরিয়েছে। আচমকা আকাশ জুড়ে বিদ্যুতের ঝলকানি, গুরু-গুরু মেঘের ডাক। সঙ্গে সোঁ-সোঁ হাওয়া। মিনিট কয়েক বাদে বৃষ্টি।তখনই কানে এল ধুপ-ধাপ আওয়াজ। ঝনঝন শব্দে জানালার কাচ ভেঙে পড়ল, টালির চাল ফাটল মড়মড়িয়ে। ছাদে-বারান্দায়-ব্যলকনিতে সাজানো ফুলের টবগুলোও চৌচির।

হুগলির রাজহাটে পেল্লায় শিলাখণ্ড হাতে দুই খুদে। ছবি: তাপস ঘোষ।

হুগলির রাজহাটে পেল্লায় শিলাখণ্ড হাতে দুই খুদে। ছবি: তাপস ঘোষ।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৪ ০৩:৩০
Share: Save:

শনিবারের রাত তখন বারোটা পেরিয়েছে। আচমকা আকাশ জুড়ে বিদ্যুতের ঝলকানি, গুরু-গুরু মেঘের ডাক। সঙ্গে সোঁ-সোঁ হাওয়া। মিনিট কয়েক বাদে বৃষ্টি।

তখনই কানে এল ধুপ-ধাপ আওয়াজ। ঝনঝন শব্দে জানালার কাচ ভেঙে পড়ল, টালির চাল ফাটল মড়মড়িয়ে। ছাদে-বারান্দায়-ব্যলকনিতে সাজানো ফুলের টবগুলোও চৌচির। তাণ্ডব থামতে বাইরে বেরিয়ে চোখ কপালে। বারান্দাময় ছড়িয়ে আছে বরফের টুকরো! কোনওটা যেন আকারে ছোটখাটো ফুটবল। কোনওটার সাইজ আধলা ইটের মতো! মাটিতে আছড়ে পড়ে সব তছনছ করে দিয়েছে!

প্রথম চৈত্রের গভীর রাতে মরসুমের প্রথম কালবৈশাখীর সঙ্গে অভূতপূর্ব শিলাবৃষ্টির সাক্ষী হয়ে রইল হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা-সহ দক্ষিণবঙ্গের একাংশ। হাওয়া অফিস অবশ্য শনিবার বিকেলেই কালবৈশাখীর সতর্কবার্তা জারি করেছিল। আর কালবৈশাখীর ঝড়ের সঙ্গে, বিশেষত বছরের প্রথম কালবৈশাখীতে শিলাবৃষ্টি খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু এত বড় আকারের শিলা সচরাচর দেখা যায় না বলে আবহবিদেরাও স্বীকার করছেন।

বস্তুত গত বর্ষা ইস্তক আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতিতে যে অনিয়ম নজরে আসছে, শনিবারের মধ্যরাত্রির শিলাবৃষ্টিতে তারই ছায়া দেখছেন আবহ-বিজ্ঞানীদের অনেকে। জানলার কাচ বা ছাদের টালি তো বটেই, অতিকায় শিলার আঘাতে বহু গাছের বিস্তর আম ফেটে গিয়েছে। আরও বেশি আম ঝরে গিয়েছে। হুগলির বিস্তীর্ণ এলাকায় বহু জমিতে পেঁপে-ধান-পেঁয়াজ-লাউ-টোম্যাটো-কপির মতো ফলন নষ্ট হয়েছে। খেতের পর খেত জুড়ে নুয়ে পড়েছে কলাগাছ। এমনকী, ক্ষতিপূরণের দাবিতে পান্ডুয়ায় কৃষকেরা রবিবার পথ অবরোধও করেন। পান্ডুয়াবাসী নব্বই বছরের ধীরেন মণ্ডলের দাবি, এ হেন ধ্বংসাত্মক শিলাবৃষ্টি তিনি জন্মাবধি দেখেননি। তাঁর পড়শি মোহন দাসের মন্তব্য, “ভাগ্যিস মাঝ রাতে হল। সন্ধে বা বিকেলে ঝড় এলে ওই শিল মাথায় লেগে মৃত্যুও হতে পারত!”

পোলবার গান্ধীগ্রামে মৃত ময়ূর। — নিজস্ব চিত্র।

শনিবার শিলার ঘায়ে কোনও মানুষের প্রাণ না-গেলেও হুগলির পোলবায় আটটা ময়ূর মারা পড়েছে বলে জেলা প্রশাসন-সূত্রের খবর। পোলবার রাজহাট ও গাঁধীগ্রাম হল ময়ূরের মুক্তাঞ্চল। বন-আধিকারিকদের অনুমান, ঝড় দেখে ভয় পেয়ে ময়ূরগুলো খোলা জায়গায় চলে এসেছিল। সেখানে শিলার আঘাত থেকে তারা নিজেদের বাঁচাতে পারেনি। কিন্তু এত বড় আকারের শিলা তৈরি হল কী ভাবে?

এ জন্য কালবৈশাখী সৃষ্টির প্রক্রিয়াটা বোঝা দরকার।

আবহবিদেরা জানিয়েছেন, চৈত্র-বৈশাখের চড়া গরমে দক্ষিণবঙ্গ ও লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের হাওয়া গরম হয়ে উপরে উঠতে থাকে। বঙ্গোপসাগর থেকে ঠান্ডা জোলো বাতাস এসে তার শূন্যস্থান পূরণ করে। গরম হাওয়া বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে উঠে ঘনীভূত হয়। তা নীচের স্তরের জোলো বাতাসের সংস্পর্শে এসে বজ্রগর্ভ-উল্লম্ব মেঘ বানায়, যা কিনা ডেকে আনে কালবৈশাখীর ঝড়। আর উল্লম্ব মেঘ সৃষ্টিকালে বাতাসের ঊর্ধ্বগতি বেশি থাকলে তার ঠেলায় জলীয় বাষ্প উঠে যায় বায়ুমণ্ডলের অনেকটা উপরে। এ দিকে বায়ুমণ্ডলের যত উপরে যাওয়া যায়, তত তাপমাত্রা কমে। ফলে জলীয় বাষ্প সেখানে উঠে ঠান্ডায় জমে শিলাখণ্ডে পরিণত হয়। সাধারণ শিলাবৃষ্টির এটাই কারণ। আবহবিদদের ব্যাখ্যা: শনিবার বাতাসের ঊর্ধ্বগতি যথেষ্ট বেশি থাকায় একসঙ্গে অনেক পরিমাণে জলীয় বাষ্প অনেক বেশি উচ্চতায় উঠে জমাট বেঁধেছিল। তাতেই শিলার আয়তন বেড়েছে বলে জানিয়েছেন আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ। আলিপুরের খবর: শনিবার রাত ন’টা নাগাদ রানিগঞ্জ, আসানসোল-সহ রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলেও প্রবল ঝড়-শিলাবৃষ্টি শুরু হয়। ক’মিনিট ধরে সেখানেও প্রকৃতি তাণ্ডব চালিয়েছে, যদিও হুগলি-উত্তর ২৪ পরগনার মতো বিশালাকৃতি শিলা পড়েনি। ঝড়ের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকেও। রানিগঞ্জে কর্মরত কয়লাসংস্থার কর্তা অভিজিৎ দাস যেমন ছবি দিয়ে লিখেছেন, “এ কি মেঘভাঙা বৃষ্টি? পনেরো মিনিটেই গাছের ঝরা পাতা আর গাড়ির ভাঙা কাচে রাস্তা ভরে গেল!”

শিল্পাঞ্চলে দক্ষযজ্ঞ চালিয়ে গভীর রাতে কালবৈশাখী হানা দেয় উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, হুগলিতে। আধ ঘণ্টার দাপাদাপিতে শ্যামনগর-কাঁকিনাড়া-নৈহাটি-বীজপুর-কাঁচরাপাড়া-পলতা-ইছাপুর-সোদপুরে বহু অ্যাসবেস্টস ও টালির চালের বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গঙ্গার ও-পারে হুগলির বিরাট তল্লাটও রেহাই পায়নি। রবিবারও বর্ধমানের বিভিন্ন অংশে শিলাবৃষ্টিও হয়েছে, তবে শিলার আকৃতি স্বাভাবিক ছিল।

কলকাতার কপালে মরসুমের প্রথম কালবৈশাখী কবে জুটবে?

এ ব্যাপারে হাওয়া অফিস নির্দিষ্ট কিছু বলতে পারেনি। শনিবার মহানগরের আকাশ মেঘলা ছিল, রবিবারেও মেঘ জমেছে। কিন্তু ঝড়-জলের দেখা মেলেনি। সন্ধ্যার পরে সল্টলেকে সামান্য বৃষ্টি হয়েছে। আজ শহরে বৃষ্টির দেখা মিলবে কি না, এখনই তার আভাস দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন আবহবিদেরা।

অন্য বিষয়গুলি:

rain
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy