নিঃশব্দে ভিন জেলা থেকে ঢুকে জাল বিছিয়েছিল কয়েকজন। শহরের একাধিক এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে মাসের পর মাস ধরে তৈরি করছিল বিস্ফোরক। মহাত্মা গাঁধীর জন্মদিনে, খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডের সূত্র ধরেই সামনে আসতে থাকে জঙ্গিদের সে সব কার্যকলাপ। তারপর সিআইডি, এনআইএ, এনএসএফএকের পর সংস্থা তদন্ত করে, তল্লাশি চালিয়ে খুঁজে বের করছে নানা তথ্য। অথচ জেলার গোয়েন্দা বিভাগের কাছেই জঙ্গিদের গতিবিধির খবর ছিল না। ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে নজরে এসেছে দফতরের দুর্বল পরিকাঠামো, কর্তারা মেনেও নিয়েছেন সে কথা।
অন্য জেলার মতো এ জেলাতেও গোয়েন্দা বিভাগ বা ডিআইবি রয়েছে। সাধারণত, প্রতিটি থানা এলাকা ধরে এরা কাজ করে। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিটি থানা এলাকায় একজন করে ডিআইও পদমর্যাদার অফিসার এবং তাঁর অধীনে তিন জন ওয়াচার বা নজরদার থাকা উচিত। কনস্টেবল পদমর্যাদার ওই ওয়াচারদের কাজ একেবারে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি-সহ নানা বিষয়ে গোপন নজরদারি চালানো। এমনকী এলাকায় অচেনা লোকজন নজরে এলে তাদের গতিবিধি খেয়াল রাখা। এছাড়া আগুন্তুকের কাছে বৈধ কাগজপত্র রয়েছে কি না সে তথ্য জোগাড় করাও নজরদারদের কাজের মধ্যেই পরে। পাশাপাশি পাসপোর্টের আবেদনকারী এবং সরকারি চাকরি প্রাপকদের পেশ করা নানা তথ্য যেমন, জন্মের শংসাপত্র, ভোটার পরিচয়পত্র, রেশন কার্ড খতিয়ে দেখেন তাঁরা। নজরদার মারফত উঠে আসা নানা তথ্য ডিআইও পাঠান জেলা সদরে থাকা ডিআইবি ডিএসপি পদমর্যাদার আধিকারিককে। সেখান থেকে রিপোর্ট পৌঁছয় জেলা পুলিশ সুপারের কাছে।
তবে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ এ দফতরের লোকবল কমতে কমতে তলানিতে ঠেকেছে। দফতর সূত্রের খবর, ডিআইও এবং নজরদার দুই পদেই রয়েছে ব্যপক ঘাটতি। থানা পিছু যেখানে তিন জন নজরদার দরকার সেখানে বেশিরভাগ থানাতেই রয়েছেন এক জন। মঙ্গলকোটের মতো হাতে গোনা কয়েকটি থানা এলাকায় অবশ্য দু’জন করে নজরদার রয়েছে। বর্ধমান সদর এলাকার বাদশাহি রোডের একটি বাড়ি থেকে সম্প্রতি ৩৫টি আইইডি উদ্ধার হয়েছিল। সেই এলাকাতেও নজরদার নেই বললেই চলে। আবার নাদনঘাটের মতো থানা এলাকা দীর্ঘদিন পড়ে রয়েছে নজরদারিবিহীন দশায়। আবার একেক জন ডিআইও-র উপর তিন থেকে চারটি থানার দায়িত্ব থাকে। যেমন, কালনা মহকুমার চারটি থানার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন এক জন ডিআইও। কাটোয়া মহকুমার তিনটি থানার দায়িত্বেও সেই এক জনই আধিকারিক। বছর পনেরো আগে পূর্বস্থলীতেও একটি ডিআইও কার্যালয় ছিল। তবে পরে পূর্বস্থলীকে কালনা মহকুমার অন্য এলাকার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়।
জেলা গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত অনেক কর্মীরই দাবি, প্রয়োজনের তুলনায় লোক ব্যপক হারে কমে যাওয়াই তাদের নজরদারির কাজে ঘাটতি হচ্ছে। এক এক জন ওয়াচারকে ১৫ থেকে ২০টি পঞ্চায়েত এলাকা দেখতে হচ্ছে, যেখানে তিন থেকে সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ বসবাস করেন। ফলে চেষ্টা থাকলেও বিশাল এলাকা জুড়ে সমান ভাবে নজরদারি সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাঁদের আরও দাবি, লোকজনের মধ্যে কাজের তাগিদে বিদেশ যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করার প্রবণতা বেড়ে যাওয়াই সমস্যা আরও বেড়েছে। কারণ এ সব আবেদনের খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে দেখতেই অনেক সময় লেগে যায়। এক নজরদারের কথায়, “এ সবের উপরে রয়েছে ভিআইপি ডিউটি। শুধু জেলাতেই নয় ভিন জেলাতেও মুখ্যমন্ত্রী অথবা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এলে আগাম তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঘটনাস্থলে। এ রকম মাসও রয়েছে যেখানে ১০ দিনেরও বেশি বাইরে কাটাতে হয়।” তাঁর প্রশ্ন, এরপরে কিভাবে কড়া নজরদারি রাখা সম্ভব? সম্প্রতি ডিআইও পদ থেকে অন্য পদে যাওয়া এক এএসআই বলেন, “জেলার কয়েকটি থানা রয়েছে সীমান্ত এলাকায়। যেগুলি দিয়ে জল ও স্থলপথে ভিন এলাকার বহু মানুষ যাতায়াত করে। এইসব বহিরাগতদের উপর কড়া নজরদারি রাখা উচিত। লোকজন কমে যাওয়াই সে কাজে ব্যাপক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।”
দফতরের ডিআইও এবং নজরদার পদে ঘাটতির কথা মেনে নিয়েছেন বর্ধমানের ডিএসপি ডিআইবি বিমল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “শুধু বর্ধমানেই নয় রাজ্যের অন্য জেলাতেও এই সমস্যা রয়েছে। তবে খাগড়াগড়ের ঘটনার পরে দফতরের তরফে নজরদারি ব্যপক বাড়ানো হয়েছে।” তবে জেলায় দুই পদে কতটা ঘাটতি রয়েছে তা অবশ্য তিনি জানাতে চান নি। জেলা গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে খবর, খাগড়াগড় ঘটনার পরে জেলা জুড়ে নানা তৎপরতা শুরু হয়েছে। কড়া নজরদারি রাখা হচ্ছে বহিরাগত কারা এলাকায় আসছে তাদের দিকে। দ্রুত পাঠানো হচ্ছে রিপোর্টও।
তবে জেলার সাধারণ মানুষের আক্ষেপ একটাই, এই তৎপরতা যদি আগে থাকত তাহলে রাজ্যের শস্যগোলা বর্ধমান হয়তো বারুদ ঘর হয়ে উঠত না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy