সিঙ্গাপুরে শিল্পপতিদের উদ্দেশে বক্তৃতা চন্দ্রশেখর রাওয়ের। শুক্রবার।
এক জন বললেন, ‘১৫ বছর পর বিদেশে পা দিলাম’। অন্য জনের কথায়, ‘মাত্র ৮০ দিন আগে আমার রাজ্যের জন্ম হয়েছে। ব্র্যান্ড হায়দরাবাদকে তুলে ধরতে আমাকে এখনই বেরিয়ে পড়তে হল’। এক জন বলছেন, ‘আসুন বাংলায় বিনিয়োগ করুন’। অন্য জনের বক্তব্য, ‘আপনাদের আসতে হবে না, আমার দফতরের ‘স্পেশ্যাল চেজিং সেল’ আপনাদের ধাওয়া করবে সব সময়’। প্রথম জনের দাবি, লগ্নির ছাড়পত্র দিতে ‘সিঙ্গল উইন্ডো সিস্টেম’ চালু করেছি। দ্বিতীয় জনের বক্তব্য, ‘সিঙ্গল উইন্ডো সিস্টেম’ এখন প্রাচীন প্রথায় পরিণত হয়েছে। আমার রাজ্যে চালু হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় ছাড়পত্র ব্যবস্থা (অটোমেটিক অ্যাপ্রুভ্যাল সিস্টেমস)। তাতে ছাড়পত্রের নামে লাল ফিতে থাকবে না। লগ্নিকারীদের উপর আস্থা রাখবে সরকার।’
এক জন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য জন তেলঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও ওরফে কেসিআর।
পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমের আয়োজনে সাঙ্গরি লা হোটেলের শিল্প সম্মেলনে মমতার শ্রোতা ছিলেন সিঙ্গাপুরের ৮৯টি শিল্প সংস্থার কর্তা। দু’এক জনকে বাদ দিলে সকলেই মাঝারি মাপের। আর র্যাফেল কনভেনশন সেন্টারে সিঙ্গাপুরে বসববাসকারী ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট-এর প্রাক্তনীদের বার্ষিক অনুষ্ঠান ‘ইমপ্যাক্ট’ সম্মেলনে হাজারখানেক প্রতিনিধির সামনে ‘আই অ্যাম দ্য চেঞ্জ’ থিমের উপরে বক্তৃতা দিলেন চন্দ্রশেখর রাও। শ্রোতাদের কেউ টেমাসেক তহবিলের কর্তা, কেউ ডিবিএস ব্যাঙ্কের শীর্ষে, কেউ বিমান সংস্থার মালিক তো কেউ ওর্যাকল, মাইক্রোসফটের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের মাথায় বসে রয়েছেন।
লক্ষ্য নগরোন্নয়ন। শুক্রবার সিঙ্গাপুরে শিল্পপতিদের সঙ্গে চন্দ্রশেখর রাও।
রাজ্যের জন্য লগ্নি টানতে মমতা এবং কেসিআর দু’জনেই প্রায় এক সময়ে সিঙ্গাপুরে এসেছেন। মমতার শিল্প সম্মেলনে নিজেদের নাম জড়াতে চায়নি সিআইআই-এর সিঙ্গাপুর শাখা। শুধু সম্ভাব্য প্রতিনিধিদের নাম-ঠিকানা জোগাড় করে দিয়েছিল তারা।
পাঁচ দিনের লম্বা সফরে এক দিন চার ঘণ্টা শিল্প সম্মেলন এবং সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ছাড়া মমতার বিশেষ কোনও কর্মসূচি ছিল না। শহরের ইতিউতি তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন জেনে প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং তাঁকে চিড়িয়াখানা দর্শনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। নাইট সাফারি, জুরং পাখিবিতান ঘুরে দেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী। চাঙ্গি বিমানবন্দরেও কাটিয়েছেন বেশ কিছু সময়। যদিও মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী এক কর্তার দাবি, “অত্যন্ত ফলপ্রসূ এই সফর। অনেক ‘নেটওয়ার্কিং’ হয়েছে। এখন শুধু যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়ার পালা।” আর এক কর্তা বলছেন, “১৩টি মউ সই থেকে শুরু করে চাঙ্গি বিমানবন্দরে বিশ্ব বাংলার স্টল করার কথা চূড়ান্ত হয়েছে। বাংলার কলাশিল্প এ বার পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলির কাছে ছড়িয়ে পড়বে।”
কেসিআর অবশ্য সিঙ্গাপুরে এসেছেন আড়াই দিনের জন্য। প্রথম দিন শিল্প সম্মেলন। তাতে সবাইকে ডাকা হয়নি। তেলঙ্গানা যে সব বিষয়ে বিনিয়োগ চায় সেই সব ক্ষেত্রের জনা চল্লিশেক শিল্পপতির আমন্ত্রণ ছিল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার জন্য। আয়োজক সিআইআই এবং ইন্ডিয়া-সিঙ্গাপুর বিজনেস ফোরাম। এই ফোরামের কর্তা টিসিএসের-সিঙ্গাপুর অফিসের প্রধান বিশ্বনাথন আয়ার। বাংলার তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের সচিব সতীশ তিওয়ারি তাঁর সঙ্গে দেখা করে রাজ্যে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন।
আর সেই বিশ্বনাথনই কেসিআরের অনুষ্ঠানের হোতা। সারাক্ষণ মঞ্চে বসে থেকে শিল্পপতিদের বোঝালেন, কেন তেলঙ্গানা গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। শিল্প সম্মেলনের পরের দিন ইমপ্যাক্টের সম্মলনে ভাষণ। তার মাঝে প্রধানমন্ত্রী-বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ। আর সিঙ্গাপুর সিটি পুলিশের সদর দফতরে গিয়ে ‘স্মাটর্’ পুলিশ-ব্যবস্থা সম্পর্কে খুঁটিয়ে জেনে আসা।
মমতার মতো জনা পঞ্চাশের প্রতিনিধিদলও সঙ্গে নেই কেসিআরের। অর্থমন্ত্রী ই রাজেন্দ্র, শিল্পসচিব প্রদীপ চন্দ্র, শিল্প কমিশনার জয়েশ রঞ্জন, তথ্যপ্রযুক্তি সচিব হরপ্রীত সিং এবং মুখ্যমন্ত্রী দফতরের এক অফিসার ছাড়া আর বিশেষ কেউ ছিলেন না তাঁর সঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছেন তারা। বিনিয়োগকারীদের সামনে নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় শিল্পসচিব প্রদীপ চন্দ্র বললেন, “আমি কলকাতা আইআইএমের ছাত্র। এই প্রতিনিধিদলের অফিসারদের মধ্যে আরও দু’জন আইআইএম প্রাক্তনী। সুতরাং আমাকে আমলা বলে ধরবেন না, আমি এক জন পেশাদার।”
কী ভাবে নিজেদের রাজ্যকে তুলে ধরলেন দুই মুখ্যমন্ত্রী? মমতা শিল্পপতিদের বললেন, “গত ৩৪ বছরে রাজ্যটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখনও ধারের কবলে পড়ে আছি আমরা। তবুও আমাদের ২১টি শিল্প পার্কে ১০ হাজার একর জমি রয়েছে। কেউ আগ্রহী থাকলে এখনই আসুন। সব রকম সাহায্য করব।” যা শুনে শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “দারুণ আবেগ ছিল মুখ্যমন্ত্রীর কথায়। উনি যে সিঙ্গাপুরের ছোট বোন হতে চান, তা এখানকার কাঠখোট্টা মানুষগুলোর মনে ধরেছে।” ব্ল্যাকস্টোনের চেয়ারম্যান আর এক বঙ্গসন্তান গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় সম্মেলনেই বলেন, “বাংলার এই প্রয়াস নজরকাড়া। এ বার কাজে করে দেখানোর পালা।”
আর চন্দ্রশেখর রাও শিল্পপতিদের বললেন, “কারখানা গড়তে গেলে জমি তো লাগবেই। কিন্তু নতুন জমি অধিগ্রহণ আইন যা হয়েছে, তাতে জমি কিনে শিল্প গড়া মুশকিল। আমার রাজ্যে সরকারের হাতেই শিল্প গড়ার জন্য ৩ লক্ষ একর জমি রয়েছে।” কেসিআর আরও বলেছেন, “তেলঙ্গানায় শিল্প গড়ার জন্য শুধু আপনাকে দরখাস্ত করতে হবে। বাকি কাজ আমার। যে দিন আপনাকে ডেকে পাঠাব সে দিন আমার প্রোটোকল অফিসার এয়ারপোর্ট থেকে আপনাকে সোজা মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে নিয়ে আসবে। আমার সমস্ত অফিসার আপনার প্রকল্প শুনবে। আপনি ফিরে যাবেন। তার দিন দশেকের মধ্যে আমার ‘অফিসার চেজিং সেল’ থেকে আপনার কাছে ফোন যাবে। একটি এনভেলপের মধ্যে সমস্ত ছাড়পত্র দিয়ে দেব।” সেই সঙ্গে কেসিআর জানাচ্ছেন, তেলঙ্গানাকে ঘুষমুক্ত রাজ্য বানানোই তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
কেসিআর-এর বক্তৃতা কেমন লাগল? ডিবিএস ব্যাঙ্কের সিইও প্রদীপ গুপ্তর বক্তব্য, “বেশ ভাল। কোনও মুখ্যমন্ত্রী এ ভাবে লগ্নি টানার জন্য ঝাঁপালে অনেকেই সেখানে যাবেন। উনি তো দেখলাম বোঝেন লগ্নিকারীরা কী চায়।” এয়ার এশিয়ার গ্রুপ সিইও টোনি ফার্নান্ডেজ বলেন, “দারুণ সুযোগ। আমি বিশাখাপত্তনম থেকে সিঙ্গাপুর এবং শ্রীলঙ্কায় বিমান চালাতে চাই। দেখি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এখানেই কথা বলে নেব।”
কেসিআরের সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা অরাকেল এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ভাস্কর জয়রামন আদতে কলকাতার লেক এলাকার বাসিন্দা। আইআইএম-জোকার ছাত্র। তিনি জানালেন, এই সম্মেলনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের মধ্যে যে কোনও এক জনকে ডাকা হবে ঠিক হয়েছিল। সমস্ত কিছু বিচার করে কেসিআরকেই ডাকা হয়েছে। কেন?
এক সংগঠকের মন্তব্য, “আমরা ইতিবাচক পরিবর্তন চেয়েছি।”
ছবি: পিটিআই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy